পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ○br রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রতিমূর্তি। দেখতে পেলুম পরম আচারনিষ্ঠ ফোটাকাটা স্থূলতনু হরিশ কুণ্ডু । সেও ছােটাে নয়, সেও বিরাট, সে যেন বঁাশবনের তলায় বহুকালের বদ্ধ পচা দিঘির উপর তেল সবুজ একটা অখণ্ড সরের মতো এ পর থেকে ও পার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে বিষ-বুদবুদ উদগীর করছে। যে প্রকাণ্ড তামসিকতা এক দিকে উপবাসে কৃশ, অজ্ঞানে অন্ধ, অবসাদে জীর্ণ, আর-এক দিকে মুমুম্বুর রক্তশোষণে স্ফীত হয়ে আপনার অবিচলিত জড়ত্বের তলায় ধরিত্রীকে পীড়িত করে পড়ে আছে, শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে । এই কাজটা মুলতুবি হয়ে পড়ে রয়েছে শত শত বৎসর ধরে । আমার মোহ ঘূচুক, আমার আবরণ কেটে যাক, আমার পৌরুষ অন্তঃপুরের স্বপ্নের জালে ব্যর্থ হয়ে জড়িয়ে পড়ে থাকে না যেন । আমরা পুরুষ, মুক্তিই আমাদের সাধনা, আইডিয়ালের ডাক শুনে আমরা সামনের দিকে ছুটে চলে যাব, দৈত্যপুরীর দেয়াল ডিঙিয়ে বন্দিনী লক্ষ্মীকে আমাদের উদ্ধার করে আনতে হবে । যে মেয়ে তার নিপুণ হাতে আমাদের সেই অভিযানের জয়পতাকা তৈরি করে দিচ্ছে সেই আমাদের সহধর্মিণী, আর ঘরের কোণে যে আমাদেৱ মায়াজাল বুনছে তার ছদ্মবেশ ছিন্ন করে তার মোহমুক্ত সত্যকার পরিচয় যেন আমরা পাই— তাকে আমাদের নিজেরই কামনার রসে-রঙে অন্সর সাজিয়ে তুলে যেন নিজের তপস্যা-ভঙ্গ করতে না পাঠাই । আজ আমার মনে হচ্ছে আমার জয় হবে ; আমি সহজের রাস্তায় দাঁড়িয়েছি, সহজ চোখে সব দেখছি ; আমি মুক্তি পেয়েছি, আমি মুক্তি দিলুম— যেখানে আমার কাজ সেইখানেই আমার উদ্ধার । আমি জানি বেদনায় বুকের নাউগুলা আবার এক-একদিন টনটন করে উঠবে। কিন্তু সেই বেদনাকেও আমি এবার চিনে নিয়েছি ; তাকে আমি আর শ্ৰদ্ধা করতে পারব না । আমি জানি সে কেবলমাত্রই আমার— তার দাম কিসের ? যে দুঃখ বিশ্বের সেই তো আমার গলার হার হবে । হে সত্য, বাচাও, আমাকে বাচাও ।— কিছুতেই আমাকে ফিরে যেতে দিয়ে না ছলনার ছদ্মস্বৰ্গলোকে । আমাকে একলা-পথের পথিক যদি কর সে পথ তোমারই পথ হোক ! আমার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে সন্দীপের আত্মকথা সেদিন অশ্রুজলের বাধ ভাঙে আর-কি | আমাকে বিমলা ডাকিয়ে আনলে, কিন্তু খানিকক্ষণ তার মুখ দিয়ে কথা বের হল না, তার দুই চোখ ঝকঝকি করতে লাগল। বুঝলুম, নিখিলের কাছে কোনো ফল পায় নি। যেমন করে হোক ফল পাবে সেই অহংকার ওর মনে ছিল, কিন্তু সে আশা আমার মনে ছিল না । পুরুষেরা যেখানে দুর্বল মেয়েরা সেখানে তাদের খুব ভালো করেই চেনে, কিন্তু পুরুষেরা যেখানে খাটি পুরুষ মেয়েরা সেখানকার রহস্য ঠিক ভেদ করতে পারে না। আসল কথা, পুরুষ মেয়ের কাছে রহস্য, আর মেয়ে পুরুষের কাছে রহস্য, এই যদি না হবে তা হলে এই দুটাে জাতের ভেদ জিনিসটা প্রকৃতির পক্ষে নেহাত একটা অপব্যয় হত । অভিমান ! যেটা দরকার সেটা ঘটল না কেন সে হিসেব মনে নেই। কিন্তু, আমি যেটা মুখ ফুটে চাইলুম সেটা কেন ঘটল না। এইটেই হল খেদ । ওদের ঐ আমির দাবিটাকে নিয়ে যে কত রঙ, কত ভঙ্গি, কত কান্না, কত ছল, কত হাবভাব তার আর অন্ত নেই ; ঐটিতেই তো ওদের মাধুর্য। ওরা আমাদের চেয়ে ঢের বেশি ব্যক্তিবিশেষ। আমাদের যখন বিধাতা তৈরি করছিলেন তখন ছিলেন তিনি ইস্কুল-মাস্টার, তখন তার বুলিতে কেবল পুঁথি আর তত্ত্ব ; আর ওদের বেলা। তিনি মাস্টারিতে জবাব দিয়ে হয়ে উঠেছেন আর্টিস্ট, তখন তুলি আর রঙের বাক্স । তাই সেই অশ্রুভরা অভিমানের রক্তিমােয় যখন বিমলা সূর্যাস্তের দিগন্তরেখায় একখানি জল-ভরা আগুন-ভরা রাঙা মেঘের মতো নিঃশব্দে দাড়িয়ে রইল সে আমার ভারি মিষ্টি দেখতে লাগল। আমি খুব কাছে গিয়ে তার হাত চেপে ধরলুম ; সে হাত ছাড়িয়ে নিলে না, থারথার করে কেঁপে উঠল।