পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে 8S বিকেলবেলায় বিমলা ঘরে আসবামাত্র টােকি থেকে উঠে তাকে বললুম, রানী, সব হয়ে এসেছে, আর দেরি নেই, এখন টাকা চাই। . বিমলা বললে, টাকা ? কত টাকা ? আমি বললুম, খুব বেশি নয়, কিন্তু যেখান থেকে হােক টাকা চাই। বিমলা জিজ্ঞাসা করলে, কত চাই বলুন । , আমি বললুম, আপাতত কেবল পঞ্চাশ হাজার মাত্র। টাকার সংখ্যাটা শুনে বিমলা ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলে, কিন্তু বাইরে সেটা গোপন করে গেল । বার বার সে কী করে বলবে যে ‘পারব না’ ? : আমি বললুম, রানী, অসম্ভবকে সম্ভব করতে পার তুমি। করেওছ। কী যে করেছ যদি দেখাতে পারতুম তো দেখতে । কিন্তু এখন তার সময় নয় ; একদিন হয়তো সময় আসবে। এখন টাকা চাই । বিমলা বললে, দেব । আমি বুঝলুম, বিমলা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে। ওর গয়না বেচে দেবে। আমি বললুম, তোমার গয়না এখন হাতে, রাখতে হবে, কখন কী দরকার হয় বলা যায় না। আমি বললুম, তোমার স্বামীর টাকা থেকে এ টাকা দিতে হবে । ) বিমলা আরো স্তম্ভিত হয়ে গেল। খানিক পরে সে বললে, তার টাকা আমি কেমন করে নেব ? আমি বললুম, তার টাকা কি তোমার টাকা নয় ? সে খুব অভিমানের সঙ্গেই বললে, নয়। ] আমি বললুম, তা হলে সে টাকা তারও নয়। সে টাকা দেশের। দেশের যখন প্রয়োজন আছে তখন এ টাকা নিখিল দেশের কাছ থেকে চুরি করে রেখেছে। বিমলা বললে, আমি সে টাকা পাব। কী করে ? ' যেমন করে হােক | তুমি সে পারবে। যার টাকা তুমি তীর কাছে এনে দেবে। বন্দেমাতরং ! ‘বন্দেমাতরং এই মন্ত্রে আজ লোহার সিন্দুকের দরজা খুলবে, ভাণ্ডারঘরের প্রাচীর খুলবে, আর যারা ধর্মের নাম করে সেই মহাশক্তিকে মানে না তাদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাবে। মক্ষী, বলো বন্দেমাতরং ! বন্দেমাতরং ! খাজনা নেব। আমরা পৃথিবীতে এসে অবধি পৃথিবীকে লুঠ করেছি ততই সে আমাদের বশ মেনেছে। আমরা পুরুষ আদিকাল থেকে ফল পেড়েছি, গাছ কেটেছি, মাটি খুঁড়েছি, পশু মেরেছি, পাখি মেরেছি, মাছ মেরেছি। সমুদ্রের তলা থেকে, মাটির নীচে থেকে, মৃত্যুর মুখের থেকে আদায়, আদায়, আমরা কেবলই আদায় করে এসেছি। আমরা সেই পুরুষজাত । বিধাতার ভাণ্ডারের কোনো লোহার সিন্দুককে আমরা রেয়াত করি নি, আমরা ভেঙেছে আর কেড়েছি। . এই পুরুষদের দাবি মেটানােই হচ্ছে ধরণীর আনন্দ । দিনরাত সেই অন্তহীন দাবি মেটাতে মেটাতেই পৃথিবী উর্বরা হয়েছে, সুন্দরী হয়েছে, সার্থক হয়েছে, নইলে জঙ্গলের মধ্যে ঢাকা পড়ে সে আপনাকে আপনি জানত না । নইলে তার হৃদয়ের সকল দরজাই বন্ধ থাকত, তার খনির হীরে । খনিতেই থেকে যেত, আর শুক্তির মুক্তো আলোতে উদ্ধার পেত না । । আমাদের কাছে আপনাকে দিতে দিতে তারা ক্ৰমে ক্রমে আপনাকে বড়ো করে বেশি করে পেয়েছে। তারা তাদের সমস্ত সুখের হীরে এবং দুঃখের মুক্তো আমাদের রাজকোষে জমা করে দিতে গিয়েই তবে তার সন্ধান পেয়েছে। এমনি করে পুরুষের পক্ষে নেওয়াই হচ্ছে যথার্থ দান, আর মেয়েদের পক্ষে দেওয়াই হচ্ছে যথার্থ লাভ | করছি। আমরা যতই তার কাছে দাবি