পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ 8br রবীন্দ্র-রচনাবলী “বধুর লাগি কেশে আমি পরব। এমন ফুল ! বাঁশির ভিতরকার ফাঁকটি সরু বলেই, চার দিকে তার বাধা বলেই, এমন সুর। অতিলোভের চাপে বাশিটি যদি ভেঙে আজ চাপটা করে দিতুম তা হলে শোনা যেত, কেন, এত টাকায় তোমার দরকার কী ? আর, আমি মেয়েমানুষ, অত টাকা পাবই বা কোথা ? ইত্যাদি ইত্যাদি । রাধিকার গানের সঙ্গে তার একটি অক্ষরও মিলত না । তাই বলছি, মোেহাঁটাই হল সত্য, সেইটেই বাঁশি, আর মোহ বাদ দিয়ে সেটা হচ্ছে ভাঙা বঁশির ভিতরকার ফাঁক— সেই অত্যন্ত নির্মল শূন্যতাটা যে কী তার আস্বাদ নিখিল আজকাল কিছু পেয়েছে, ওর মুখ দেখলেই সেটা বােঝা যায়। আমার মনেও কষ্ট লাগে । কিন্তু নিখিলের বড়াই, ও সত্যকে চায়, আমার বড়াই আমি মোহটাকে পারতপক্ষে হাত থেকে ফাঁসকাতে দেব না। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিৰ্ভবতি তাদৃশী । অতএব এ নিয়ে দুঃখ করে কী হবে ? বিমলার মনটাকে সেই উপরের হাওয়াতেই উড়িয়ে রাখবার জন্য পাঁচ হাজার টাকা সংক্ষেপে সেরে ফেলে, ফের আবার সেই মহিষমদিনীর পুজোর মন্ত্রণায় বসে গেলুম । পুজোটা হবে কবে এবং কখন ? নিখিলের এলাকায় রুইমারিতে অঘানের শেষে যে হােসেনগাজির মেলা হয় সেখানে লক্ষ লক্ষ লোক আসে, সেইখানে পুজোটা যদি দেওয়া যায় তা হলে খুব জমাট হয়। বিমলা উৎসাহিত হয়ে উঠল। ও মনে করলে এ তো বিলিতি কাপড় পোড়ানো নয়, লোকের ঘর জ্বালানো নয়, এত বড়ো সাধু প্ৰস্তাবে নিখিলের কোনো আপত্তি হবে না । আমি মনে মনে হাসলুম— যারা ন বছর দিনরাত্তির একসঙ্গে কাটিয়েছে তারাও পরস্পরকে কত অল্প চেনে ! কেবল ঘরকন্নার কথাটুকুতেই চেনে, ঘরের বাইরের কথা যখন হঠাৎ উঠে পড়ে তখন তারা আর থাই পায় না । ওরা ন বছর ধরে বসে বসে এই কথাটাই ক্ৰমাগত বিশ্বাস করে এসেছে যে, ঘরের সঙ্গে বাইরের অবিকল মিল বুঝি আছেই ; আজ ওরা বুঝতে পারছে, কোনােদিন যে-দুটােকে মিলিয়ে নেওয়া হয় নি। আজ তারা হঠাৎ মিলে যাবে কী করে। যাক, যারা ভুল বুঝেছিল তারা ঠেকতে ঠেকতে ঠিক করে বুঝে নিক, তা নিয়ে আমার বেশি চিন্তা করবার দরকার নেই। বিমলাকে তো এই উদ্দীপনার বেগে বেলুনের মতো অনেকক্ষণ উড়িয়ে রাখা সম্ভব নয়, অতএব এই হাতের কাজটা যত শীঘ পারা যায়। সেরে নিতে হচ্ছে । বিমলা যখন চৌকি থেকে উঠে দরজা পর্যন্ত গেছে আমি নিতান্ত যেন উড়ো রকম ভাবে বললুম, রানী, তা হলে টাকাটা কাবে আমি বললুম, না, দেরি হলে চলবে না । তোমার কবে চাই ? কালই । আচ্ছা কালই এনে দেব। নিখিলেশের আত্মকথা আমার নামে কাগজে প্যারাগ্রাফ এবং চিঠি বেরোতে শুরু হয়েছে ; শুনছি। একটা ছড়া এবং ছবি বেরোবে তারও উদ্যোগ হচ্ছে। রসিকতার উৎস খুলে গেছে, সেইসঙ্গে অজস্র মিথ্যেকথার ধারাবর্ষণে সমস্ত দেশ একেবারে পুলকিত | জানে যে এই পঙ্কিল রসের হােরিখেলায় পিচকিরিটা তাদেরই হাতে ; আমি ভদ্রলোক রাস্তার এক পাশ দিয়ে চলেছি, আমার গায়ের আবরণখানা সাদা রাখবার উপায় নেই । লিখেছে, আমার এলেকায় আপামর সাধারণ সকলেই স্বদেশীর জন্যে একেবারে উৎসুক হয়ে রয়েছে, কেবল আমার ভয়েই কিছু করতে পারছে না, দুই-একজন সাহসী যারা দিশি জিনিস চালাতে চায় জমিদারি চালে আমি তাদের বিধিমতে উৎপীড়ন করছি । পুলিসের সঙ্গে আমার তলে তলে যোগ আছে, ম্যাজিষ্ট্রেটের সঙ্গে আমি গোপনে চিঠি-চালাচালি করছি এবং বিশ্বস্তসূত্রে খবরের কাগজ খবর