পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○(?ひ রবীন্দ্র-রচনাবলী বেরোল ; এই তার শেষ সম্বল। জমিদারের শাসনে গ্রামের কেউ তার গয়না কিনতেও সাহস করে না । জমিদারের নায়েব বললে, আমি কিনব, পাচ টাকা দামে । দাম তার টাকা ত্ৰিশ হবে। প্ৰাণের দায়ে পােচ টাকাতেই যখন সে রাজি হল তখন তার গয়নার পুঁটুলি নিয়ে নায়েব বললে, এই পাঁচ টাকা তোমার খাজনা-বাকিতে জমা করে নিলুম। এই কথা শুনে আমরা সন্দীপবাবুকে বলেছিলুম, চক্রবর্তকে আমরা বয়কট করব । সন্দীপবাবু বললেন, এই সমস্ত জ্যান্ত লোককেই যদি বাদ দাও তা হলে কি ঘাটের মড়া নিয়ে দেশের কাজ করবে ? এরা প্ৰাণপণে ইচ্ছে করতে জানে, এরাই তো প্ৰভু । যারা ষোলো-আনা ইচ্ছে করতে জানে না তারা হয় এদের ইচ্ছেয় চলবে নয়। এদের ইচ্ছেয় মরবো । তিনি আপনার সঙ্গে তুলনা করে বললেন, আজ চক্রবর্তীর এলেকায় একটি মানুষ নেই যে স্বদেশী নিয়ে টু শব্দটি করতে পারে, অথচ নিখিলেশ হাজার ইচ্ছে করলেও স্বদেশী চালাতে পারবেন না। পক্ষে শক্ত । আমি মরা খুঁটি চাই নে তো, আমি জ্যান্ত গাছ চাই। আমার কাজে দেরি হবে। ঐতিহাসিক হেসে বললেন, আপনি মরা খুঁটিও পাবেন না, জ্যান্ত গাছও পাবেন না। কেননা, সন্দীপবাবুর কথা আমি মানি, পাওয়া মানেই কেড়ে নেওয়া। এ কথা শিখতে আমাদের সময় লেগেছে ; কেননা, এগুলো ইস্কুলের শিক্ষার উল্টো শিক্ষা । আমি নিজের চােখে দেখেছি, কুণ্ডুদের গোমস্ত গুরুচরণ ভাদুড়ি টাকা আদায় করতে বেরিয়েছিল। একটা মুসলমান প্রজার বেচে-কিনে নেবার মতো কিছু ছিল না | ছিল তার যুবতী স্ত্রী। ভাদুড়ি বললে, তোর বউকে নিকে দিয়ে টাকা শোধ করতে হবে । নিকে করবার উমেদার জুটে গেল, টাকাও শোধ হল । আপনাকে বলছি, স্বামীটার চোখের জল দেখে আমার রাত্রে ঘুম হয় নি, কিন্তু যতই কষ্ট হােক আমি এটা শিখেছি যে, যখন টাকা আদায় করতেই হবে তখন যে মানুষ ঋণীর স্ত্রীকে বেচিয়ে টাকা সংগ্ৰহ করতে পারে মানুষ-হিসেবে সে আমার চেয়ে বড়ো ; আমি পারি নে, আমার চোখে জল আসে, তাই সব ফেসে যায়। আমার দেশকে কেউ যদি বাচায়। তবে এই-সব গোমস্তা, এই সব কুণ্ডু, এই-সব চক্রবর্তীরা । আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম ; বললুম, তাই যদি হয়, তবে এই-সব গোমস্তা এই-সব কুণ্ডু এই-সব চক্রবর্তীদের হাত থেকে দেশকে বাচাঁবার কােজই আমার । দেখো, দাসত্বের যে বিষ মজার মধ্যে আছে সেইটেই যখন সুযোগ পেয়ে বাইরে ফুটে ওঠে তখনই সেটা সাংঘাতিক দীেরাত্ম্যের আকার ধরে। বউ হয়ে যে মার খায় শাশুড়ি হয়ে সেই সব চেয়ে বড়ো মার মারে । সমাজে যে মানুষ মাথা হেঁট করে থাকে সে যখন বরযাত্র হয়ে বেরোয় তখন তার উৎপাতে মানী গৃহস্থের মান রক্ষা করা অসাধ্য। ভয়ের শাসনে তোমরা নিবিচারে কেবলই সকল-তাতেই সকলকে মেনে এসেছে, সেইটোকেই ধর্ম বলতে শিখেছি, সেইজন্যেই আজকে অত্যাচার করে সকলকে মানানোটাকেই তোমরা ধর্ম বলে মনে করছি । আমার লড়াই দুর্বলতার ঐ নিদারুণতার সঙ্গে । আমার এ-সব কথা অত্যন্ত সহজ কথা, সরল লোককে বললে বুঝতে তার মুহূর্তমাত্র দেরি হয় না, কিন্তু আমাদের দেশে যে-সব এম, এ, ঐতিহাসিক বুদ্ধির প্যাচ কষছে। সত্যকে পরাস্ত করবার জন্যেই তাদের প্যাচ । এ দিকে পঞ্চর জাল মামীকে নিয়ে ভাবছি। তাকে অপ্রমাণ করা কঠিন। সত্য ঘটনার সাক্ষীর সংখ্যা পরিমিত, এমন-কি, সাক্ষী না থাকাও অসম্ভব নয়, কিন্তু যে ঘটনা ঘটে নি জোগাড় করতে পারলে তার সাক্ষীর অভাব হয় না। আমি যে মীেরসি স্বত্ব পঞ্চর কাছ থেকে কিনেছি সেইটো কঁচিয়ে (नदाल 6ठे यानि । আমি নিরুপায় দেখে ভাবছিলুম পাঞ্চকে আমার নিজ এলাকাতেই জমি দিয়ে ঘরবাড়ি করিয়ে দিই। কিন্তু মাস্টারমশায় বললেন, অন্যায়ের কাছে সহজে হার মানতে পারব না । আমি নিজে চেষ্টা দেখব । আপনি চেষ্টা দেখবেন ? ই, আমি । এ-সমস্ত মামলা-মকদ্দমার ব্যাপার, মাস্টারমশায় যে কী করতে পারেন বুঝতে পারলুম না।