পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সন্ধ্যাবেলায় যে সময়ে রোজ আমার সঙ্গে তার দেখা হয় সেদিন দেখা হল না। খবর নিয়ে জানলুম, তিনি তার কাপড়ের বাক্স আর বিছানা নিয়ে বেরিয়ে গেছেন ; চাকরদের কেবল এইটুকু বলে গেছেন, ষ্ঠার ফিরতে দু-চারদিন দেরি হবে। আমি ভাবলুম, সাক্ষী সংগ্ৰহ করবার জন্যে তিনি পঞ্চাদের মামার বাড়িতেই বা চলে গেছেন। তা যদি হয় আমি জানি সে তীর বৃথা চেষ্টা হবে। জগদ্ধাত্রী-পুজো মহরম এবং রবিবারে জড়িয়ে তঁর ইস্কুলের কয়দিন ছুটি ছিল ; তাই ইস্কুলেও তীর খোজ পাওয়া গেল না। হেমন্তের বিকেলের দিকে দিনের আলোর রঙ যখন ঘোলা হয়ে আসতে থাকে তখন ভিতরে ভিতরে মনেরও রঙ বদল হয়ে আসে। সংসারে অনেক লোক আছে যাদের মনটা কোঠাবাড়িতে বাস করে। তারা ‘বাহির বলে পদার্থকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চলতে পারে। আমার মনটা আছে যেন গাছতলায় । বাইরের হাওয়ার সমস্ত ইশারা একেবারে গায়ের উপরে এসে পড়ে, আলো-অন্ধকারের সমস্ত মিড় বুকের ভিতরে বেজে ওঠে। দিনের আলো যখন প্রখর থাকে তখন সংসার তার অসংখ্য কােজ নিয়ে চার দিকে ভিড় করে দাঁড়ায়, তখন মনে হয় জীবনে এ ছাড়া আর কিছুরই দরকার নেই। কিন্তু যখন আকাশ স্নান হয়ে আসে, যখন স্বর্গের জানলা থেকে মর্তের উপর পর্দা নেমে আসতে থাকে, তখন আমার মন বলে, জগতে সন্ধ্যা আসে সমস্ত সংসারটাকে আড়াল করবার জন্যেই ; এখন কেবল একের সঙ্গ অনন্ত অন্ধকারকে ভরে তুলবে। এইটেই ছিল জল স্থল আকাশের একমাত্র মন্ত্রণা। দিনের বেলা যে প্রাণ অনেকের মধ্যে বিকশিত হয়ে উঠবে সন্ধ্যার সময় সেই প্ৰাণই একের মধ্যে মুদে আসবে, আলো-অন্ধকারের ভিতরকার অর্থটাই ছিল এই । আমি সেটাকে অস্বীকার করে কঠিন হয়ে থাকতে পারি নে। তাই সন্ধ্যাটি যেই জগতের উপর প্ৰেয়সীর কালো চোখের তারার মতো অনিমেষ হয়ে ওঠে তখন আমার সমস্ত দেহমান বলতে থাকে, সত্য নয়, এ কথা কখনোই সত্য নয় যে, কেবলমাত্র কাজই মানুষের আদি অন্ত ; মানুষ একান্তই মজুর নয়, হােক-না সে সত্যের মজুরি, ধর্মের মজুরি। সেই তারার-আলোয় ছুটি-পাওয়া কাজের-বাইরেকার মানুষ, সেই অন্ধকারের অমৃতে ডুবে মরবার মানুষটিকে তুই কি চিরদিনের মতো হারালি নিখিলেশ ? সমস্ত সংসারের অসংখ্যতাও যে জায়গায় মানুষকে লেশমাত্র সঙ্গ দিতে পারে না সেইখানে যে লোক একলা হয়েছে সে কী ভয়ানক একলা ! সেদিন বিকেলবেলাটা ঠিক যখন সন্ধ্যার মোহানাটিতে এসে পৌচেছে তখন আমার কাজ ছিল না, কাজে মনও ছিল না, মাস্টারমশায়ও ছিলেন না, শূন্য বুকটা যখন আকাশে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছিল তখন আমি বাড়ি-ভিতরের বাগানে গেলুম। আমার চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বড়ো শখ। আমি টবে করে নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকা বাগানে সাজিয়েছিলুম, যখন সমস্ত গাছ ভরে ফুল ফুটে উঠত। তখন মনে হত সবুজ সমুদ্রে ঢেউ লেগে রঙের ফেনা উঠেছে। কিছুকাল আমি বাগানে যাই নি, আজ মনে মনে একটু হেসে বললুম, আমার বিরাহিণী চন্দ্রমল্লিকার বিরহ ঘুচিয়ে আসি গে। বাগানে যখন ঢুকলুম তখন কৃষ্ণ-প্রতিপদের চাঁদটি ঠিক আমাদের পাচিলের উপরটিতে এসে মুখ বাড়িয়েছে। পাচিলের তলাটিতে নিবিড় ছায়া, তারই উপর দিয়ে বঁকা হয়ে চাঁদের আলো বাগানের পশ্চিম দিকে এসে পড়েছে। ঠিক আমার মনে হল চাঁদ যেন হঠাৎ পিছন দিক থেকে এসে অন্ধকারের চোখ টিপে ধরে মুচকে হাসছে। । 象 w পাচিলের যে ধারাটিতে গ্যালারির মতো করে থাকে থাকে চন্দ্রমল্লিকার টব সাজানো রয়েছে সেই দিকে গিয়ে দেখি সেই পুষ্পিত সোপানশ্রেণীর তলায় ঘাসের উপরে কেচুপ করে শুয়ে আছে। আমার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। আমি কাছে যেতেই সেও চমকে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। তার পর কী করা যায় ? আমি ভাবছি আমি এইখান থেকে ফিরে যাব কি না, বিমলাও নিশ্চয় ভাবছিল সে উঠে চলে যাবে কি না। কিন্তু থাকাও যেমন শক্ত, চলে যাওয়াও তেমনি। আমি কিছু একটা মনস্থির করার পূর্বেই বিমলা উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বাড়ির দিকে চলল। সেই একটুখানি সময়ের মধ্যেই বিমলার দুর্বিষহ দুঃখ আমার কাছে যেন মূর্তিমান হয়ে দেখা দিল । সেই মুহুর্তে আমার নিজের জীবনের নালিশ কোথায় দূরে ভেসে গেল। আমি তাকে ডাকলুম, বিমলা ! Κα