পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে । ¢¢ዩ) কেউ হতে পারে এ কথা সে মনে করতেও পারেনি। দেখলে যে আমি রয়েই গেলুম। তার পরে তার লজ্জা হতে লাগল। আমি তাকে বললুম, মা, আমাকে তো তুমি অপমান করে তাড়াতে পারবে না। আর, আমি যদি থাকি তা হলে পঞ্চকেও রাখব ; ওর মা-হারা সব ছোটাে ছোটাে ছেলেমেয়ে, তারা পথে বেরোবে এ তো আমি দেখতে পারব না। দুদিন আমার কথা চুপ করে শুনলে; হাঁও বলে না, “নাও বলে না ; শেষকালে আজ দেখি পোটলাপুটলি বাঁধছে। বললে, আমরা বৃন্দাবনে যাব, আমাদের পথখরচ দাও। বৃন্দাবনে যাবে না জানি, কিন্তু একটু মোটারকম পথখরচ দিতে হবে। তাই তোমার কাছে এলুম। আচ্ছা, সে যা দরকার তা দেব । বুড়িটা লোক খারাপ নয়। পঞ্চ ওকে জলের কলসী ষ্টুতে দেয় না, ঘরে এলেহী-ই করে ওঠেতাই নিয়ে ওর সঙ্গে খুঁটিনাটি চলছিল। কিন্তু ওর হাতে আমার খেতে আপত্তি নেই শুনে আমাকে যত্নের একশেষ করেছে। চমৎকার রাধে। আমার উপরে পঞ্চর ভক্তিশ্রদ্ধা যে একটুখানি ছিল তাও এবার চুকে গেল। আগে ওর ধারণা ছিল অন্তত, আমি লোকটা সরল ; কিন্তু এবার ওর ধারণা হয়েছে আমি যে বুড়িটার হাতে খেলুম সেটা কেবল তাকে বশ করবার ফন্দি। সংসারে ফন্দিটা চাই বটে, কিন্তু তাই বলে একেবারে ধর্মটা খোয়ানো ? মিথ্যে সাক্ষিতে আমি বুড়ির উপর যদি টেক্কা দিতে পারতুম তা । হলে বটে বোঝা যেত। যা হােক, বুড়ি বিদায় হলেও কিছুদিন আমাকে পঞ্চর ঘর আগলে থাকতে । হবে, নইলে হরিশ কুণ্ডু কিছু-একটা সাংঘাতিক কাণ্ড করে বসবে। সে নাকি ওর পরিষদদের কাছে বলেছে, আমি ওর একটা জাল মামী জুটিয়ে দিলুম, ও বেঁটা আমার উপর টেক্কা মেরে কোথা থেকে এক জাল বাবার জোগাড় করেছে! দেখি ওর বাবা ওকে বাচায় কী করে। আমি বললুম, ও বীচিতেও পারে, মরতেও পারে, কিন্তু এই-যে এরা দেশের লোকের জন্যে হাজার হারও হয় তা হলেও আমরা সুখে মরতে পারব। বিমলার আত্মকথা এক জন্মে যে এতটা ঘটতে পারে সে মনেও করা যায় না। আমার যেন সাত জন্ম হয়ে গেল। এই কয় মাসে হাজার বছর পার হয়ে গেছে। সময় এত জোরে চলছিল যে, চলছে বলে বুঝতেই পারিনি। সেদিন হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পেরেছি। বাজার থেকে বিদেশী মাল বিদায় করবার কথা যখন স্বামীর কাছে বলতে গেলুম তখন জানতুম এই নিয়ে খানিকটা কথা-কাটাকাটি চলবে । কিন্তু আমার একটা বিশ্বাস ছিল যে, তর্কের দ্বারা তর্ককে নিরস্ত করা আমার পক্ষে অনাবশ্যক। আমার চার দিকের বায়ুমণ্ডলে একটা জাদু আছে। সদীপের মতো অতবড়ো একটা পুরুষ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো যে আমার পায়ের কাছে এসে ভেঙে পড়ল- “ আমি তো ডাক দিই নি, সে আমার এই হাওয়ার ডাক। আর সেদিন দেখলুম, সেই অমূল্যকে, আহা সে ছেলেমানুষ, কচি মুরলী বঁাশটির মতো সরল এবং সরস, সে আমার কাছে যখন এল তখন ভোরবেলাকার নদীর মতো দেখতে দেখতে তার জীবনের ধারার ভিতর থেকে একটি রঙ ফুটে উঠল। দেবী তীর ভক্তের মুখের দিকে চেয়ে যে কিরকম মুগ্ধ হতে পারেন সেদিন অমূল্যর দিকে চেয়ে আমি তা বুঝতে পারলুম। আমার শক্তির সোনার কাঠি যে কেমনতরো কাজ করে এমনি করে তো তা দেখতে পেয়েছি। ” - তাই সেদিন নিজের পরে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বজ্ৰবাহিনী বিদ্যুৎশিখার মতো আমার স্বামীর কাছে গিয়েছিলুম। কিন্তু, হল কী ? আজ ন বছরে একদিনও স্বামীর চোখে এমন উদাস দৃষ্টি দেখি নি। সে যেন মরুভূমির আকাশের মতাে, তার নিজের মধ্যেও একটুখানি রসের বাষ্প নেই, আর যার দিকে