পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

C (ሱ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তাকিয়ে আছে তার মধ্যেও যেন কোথাও কিছুমাত্র রঙ দেখা যাচ্ছে না। একটু যদি রাগও করতেন তা হলেও বঁচিতুম। কোথাও তাকে ছুতেও পারলুম না। মনে হল আমি মিথ্যে। যেন আমি স্বপ্ন ; স্বপ্নটা যেই ভেঙে গেল, অমনি কেবল অন্ধকার রাত্রি । এতকাল রূপের জন্যে আমার রূপসী জাদের ঈর্ষা করে এসেছি। মনে জানতুম বিধাতা আমাকে শক্তি দেন নি, আমার স্বামীর ভালোবাসাই আমার একমাত্র শক্তি । আজ যে শক্তির মদ পেয়ালা ভরে খেয়েছি, নেশা জমে উঠেছে। এমন সময় হঠাৎ পেয়ালাটা ভেঙে মাটির উপর পড়ে গেল। এখন বঁচি কী করে । তাড়াতাড়ি খোপা বঁধতে বসেছিলুম ! লজ্জা ! লজ্জা ! লজ্জা ! মেজোরানীর ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি বলে উঠলেন, কী লো ছোটােরানী, খোপাটা যে মাথা ডিঙিয়ে লাফ মারতে চায়, মাথাটা ঠিক আছে তো ? সেদিন বাগানে স্বামী আমাকে অনায়াসে বললেন, তোমাকে ছুটি দিলুম। ছুটি কি এতই সহজে দেওয়া যায় কিংবা নেওয়া যায় ? ছুটি কি একটা জিনিস ? ছুটি যে ফাকা। মাছের মতো আমি যে চিরদিন আদরের জলে সাতার দিয়েছি, হঠাৎ আকাশে তুলে ধরে যখন বললে এই তোমার ছুটি”— তখন দেখি এখানে আমি চলতেও পারি নে, বাচাতেও পারি। নে । আজ শোবার ঘরে যখন ঢুকি তখন শুধু দেখি আসবাব, শুধু আলনা, শুধু আয়না, শুধু খািট ! এর উপরে সেই সর্বব্যাপী হৃদয়টি নেই। রয়েছে ছুটি, কেবল ছুটি, একটা ফাঁক । ঝর্না একেবারে শুকিয়ে গেল, পাথর আর নুড়িগুলো বেরিয়ে পড়েছে। আদর নেই, আসবাব ! এ জগতে সত্য আমার পক্ষে কোথায় কতটুকু টিকে আছে সে সম্বন্ধে হঠাৎ যখন এতবড়ো একটা ধাধা লাগল। তখন আবার দেখা হল সন্দীপের সঙ্গে | প্ৰাণের সঙ্গে প্ৰাণের ধাক্কা লেগে সেই আগুন তো আবার তেমনি করেই জুলল। কোথায় মিথ্যে ? এ যে ভরপুর সত্য, দুই কুল ছাপিয়ে-পড়া সত্য । এই-যে মানুষগুলো সব ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথা কচ্ছে, হাসছে— ঐ-যে বড়োরানী মালা জাপছেন, মেজোরানী থাকো দাসীকে নিয়ে হাসছেন, পাচালীর গান গাচ্ছেন— আমার ভিতরকার এই আবির্ভাব যে এই-সমস্তর চেয়ে হাজার গুণে সত্য | সন্দীপ বললেন, পঞ্চাশ হাজার চাই । আমার মাতাল মন বলে উঠল, পঞ্চাশ হাজার কিছুই নয়, এনে দেব ! কোথায় পাব, কী করে পাব, সেও কি একটা কথা ! এই তো আমি নিজে এক মুহুর্তে কিছু-না থেকে একেবারে সব-কিছুকে যেন ছাড়িয়ে উঠেছি ! এমনি করেই এক ইশারায় সব ঘটনা ঘটবে। পারব। পারব। পারব ! একটুও সন্দেহ নেই। : চলে তো এলুম। তার পর চার দিকে চেয়ে দেখি, টাকা কই ? কল্পতরু কোথায় ? বাহিরটা মনকে এমন করে লজ্জা দেয় কেন ? কিন্তু তবু টাকা এনে দেবই । যেমন করেই হোক, তাতে গ্লানি নেই । যেখানে দীনতা সেখানেই অপরাধ, শক্তিকে কোনো অপরাধ স্পৰ্শই করে না । চোরই চুরি করে, বিজয়ী রাজা লুঠ করে নেয়। কোথায় মালখানা, সেখানে কার হাতে টাকা জমা হয়, পাহারা দেয় কারা, এই-সব সন্ধান করছি ! অর্ধেক রাত্রে বাহির-বাড়িতে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দফতরখানার দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে কাটিয়েছি। ঐ লোহার গরাদের মুঠো থেকে পঞ্চাশ হাজার ছিনিয়ে নেব কী করে ? মনে দয়া ছিল না । যারা পাহারা দিচ্ছে তারা যদি মন্ত্রে ঐখানে মরে পড়ে তা হলে এখনই আমি উন্মত্ত হয়ে ঐ ঘরের মধ্যে ছুটে যেতে পারি। এই বাড়ির রানীর মনের মধ্যে ডাকাতের দল খাড়া হাতে নৃত্যু করতে করতে দেবীর কাছে বর মাগতে লািগল— কিন্তু বাইরের আকাশ নিঃশব্দ হয়ে রইল, প্রহরে প্রহরে পাহারা বদল হতে লাগল, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঢং ঢেং করে ঘণ্টা বাজল, বৃহৎ রাজবাড়ি নিৰ্ভয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে রইল । শেষকালে একদিন অমূল্যকে ডাকলুম । বললুম, দেশের জন্যে টাকার দরকার, খাজাঞ্চির কাছ থেকে এ টাকা বের করে আনতে পারবে না ? সে বুক ফুলিয়ে বললে, কেন পারব না ?