পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে k (፩6:ዒ প্ৰণামী দিয়ে থাকেন। সেই টাকা বছরে বছরে তঁদের নামে ব্যাঙ্কে জমা হয়ে সুদে বাড়ছে। এবারেও নিয়মমত প্ৰণামী দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জানি টাকাটা এখনো ব্যাঙ্কে পাঠানো হয় নি। কোথায় আছে তাও আমার জানা। আমাদের শোবার ঘরের সংলগ্ন কাপড়-ছাড়বার ছোটাে কুঠরির কোণে লোহার সিন্দুক আছে, তারই মধ্যে টাকাটা তোলা হয়েছে। ফি বছরে এই টাকা নিয়ে আমার স্বামী কলকাতার ব্যাঙ্কে জমা দিতে যান ; এবারে তীর আর যাওয়া হল না । এইজন্যেই তো দৈবকে মানি । এই টাকা দেশ নেবেন বলেই আটক আছে। এ টাকা ব্যাঙ্কে নিয়ে যায়। সাধ্যকার ? আর এই টাকা আমি না নিই এমন সাধ্যই বা আমার কই ? প্ৰলয়ংকরী খপর বাড়িয়ে দিয়েছেন ; বলছেন, আমি ক্ষুধিত, আমাকে দে! আমি আমার বুকের রক্ত দিলুম, ঐ পাঁচ । হাজার টাকায়। মা গো, এই টাকা। যার গেল তার সামান্যই ক্ষতি হবে, কিন্তু আমাকে এবার তুমি একেবারে, ফতুর করে নিলে । , এর আগে কতদিন বড়োরানী-মেজোরানীকে আমি মনে মনে চোর বলেছি ; আমার বিশ্বাসপরায়ণ স্বামীকে ভুলিয়ে তঁরা ফাকি দিয়ে কেবল টাকা নিচ্ছেন, এই ছিল আমার নালিশ ; তাদের স্বামীদের মৃত্যুর পরে অনেক সরকারি জিনিসপত্র তারা লুকিয়ে সরিয়েছেন, এ কথা অনেকবার স্বামীকে বলেছি। তিনি তার কোনাে জবাব না করে চুপ করে থাকতেন। তখন আমার রাগ হত ; আমি বলতুম, দান করতে হয়। হাতে তুলে দান করো, কিন্তু চুরি করতে দেবে কেন ? বিধাতা সেদিন আমার এই নালিশ । শুনে মুচকে হেসেছিলেন, আজ আমি আমার স্বামীর সিন্দুক থেকে ঐ বড়োরানীর মেজোরানীর টাকা চুরি করতে চলেছিা! রাত্রে আমার স্বামী সেই ঘরেই তার জামাকাপড় ছাড়েন, সেই জানার পকেটেই তার চাবি থাকে। সেই চাবি বের করে নিয়ে লোহার সিন্দুক খুললুম। অল্প যে একটু শব্দ হল, মনে হল সমস্ত পৃথিবী যেন জেগে উঠল। হঠাৎ একটা শীতে আমার হাত-পা হিম হয়ে বুকের মধ্যে ঠক ঠক করে কঁাপিতে থাকিল । । লোহার সিন্দুকের মধ্যে একটা টানা দেরাজ আছে। সেইটে খুলে দেখলুম নোট নেই, কাগজের মোড়কে ভাগ করা গিনি সাজানো। প্রতি মোড়কে কত গিনি আছে, আমার কত দরকার, সে তখন হিসেব করবার সময় নয়। কুড়িটি মোড়ক ছিল, সবকটা নিয়েই আমার আঁচলে বাধালুম। কম ভারী নয়! চুরির ভারে আমার মন যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হয়তো নোটের তাড়া হলে সেটাকে এত বেশি চুরি বলে মনে হত না। এ যে সব সোনা ! সেই রাত্রে নিজের ঘরে যখন চাের হয়ে ঢুকতে হল তখন থেকে এ ঘর আমার আর আপনি রইল না। এ ঘরে আমার কত বড়ো অধিকার ! চুরি করে সক খেয়ালুম। : মনে মনে জপতে লাগলুম, বন্দেমাতরং, বন্দেমাতরং ! দেশ, আমার দেশ, আমার সোনার দেশ ! সব সোনা সেই দেশের সোনা, এ আর কারও নয় ! কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে মন যে দুর্বল হয়ে থাকে। স্বামী পাশের ঘরে ঘুমােচ্ছিলেন, চােখ বুজে তার ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলুম। অন্তঃপুরের খোলা ছাদের উপর গিয়ে সেই আঁচলে বাঁধা চুরির উপর বুক দিয়ে মাটিতে পড়ে রইলুম, সেই মোড়কগুলো বুকে বাজতে লাগল। নিস্তব্ধ রাত্রি আমার শিয়রের কাছে তর্জনী তুলে রইল। ঘরকে তো আমি দেশ থেকে স্বতন্ত্র করে দেখতে পারলুম না। আজ ঘরকে লুটেছি, দেশকেই লুটেছি ; এই পাপে একই সঙ্গে ঘর আমার ঘর রইল না, দেশও হয়ে । গেল পর। আমি যদি ভিক্ষে করে দেশের সেবা করতুম এবং সেই সেবা সম্পূর্ণনা করেও মরে যৌতুম, তবে সেই অসমাপ্ত সেবাই হত পূজা, দেবতা তা গ্ৰহণ করতেন। কিন্তু চুরি তাে পূজা নয় ; এ জিনিস কেমন করে দেশের হাতে তুলে দেব ! চােরাই মালে দেশের ভরা ডোবাতে বসলুম গো ! নিজে মরতে বসেছি, কিন্তু দেশকে আঁকড়ে ধরে তাকে সুদ্ধ কেন অশুচি করি ! এ টাকা লোহার সিন্দুকে ফেরবার পথ বন্ধ। আবার এই রাত্রে সেই ঘরে ফিরে গিয়ে সেই চাবি নিয়ে সেই সিন্দুক খােলবার শক্তি আমার নেই। আমি তা হলে স্বামীর ঘরের চৌকাঠের কাছে অজ্ঞান