পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(f\VS রবীন্দ্র-রচনাবলী এমনি করে মেজেরানী অনর্গল বকে যেতে লাগলেন, তারই মাঝে মাঝে ছেচকিটা ঘণ্টট চিংড়িমাছের মুড়োটার প্রতিও ঠাকুরপোর মনােযোগ আকর্ষণ করা চলতে থাকল। আমার তখন মাথা ঘুরছে। আর তো সময় নেই, এখনই একটা উপায় করতে হবে। কী হতে পারে, কী করা যেতে পারে, এই কথা যখন বার বার মনকে জিজ্ঞাসা করছি তখন মেজোরানীর বকুনি আমার কাছে অত্যন্ত অসহ্য বোধ হতে লাগল। বিশেষত আমি জানি মেজোরানীর চোখে কিছুই এড়ায় না ; তিনি ক্ষণে ক্ষণে আমার মুখের দিকে চাচ্ছিলেন, কী দেখছিলেন জানি নে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমার মুখে সমস্ত কথাই যেন স্পষ্ট ধরা পড়ছিল । দুঃসাহসের অন্ত নেই। আমি যেন নিতান্ত সহজ কৌতুকে হেসে উঠলুম ; বলে উঠলুম, আসল কথা, আমার 'পরেই মেজোরানীর যত অবিশ্বাস, চোর ডাকাত সমস্ত বাজে কথা । মেজেরানী মূচকে হেসে বললেন, তা ঠিক বলেছিস লো, মেয়েমানুষের চুরি বড়ো সর্বনেশে ; তা, আমার কাছে ধরা পড়তেই হবে, আমি তো আর পুরুষমানুষ নই। আমাকে ভোলাবি কী দিয়ে ? আমি বললুম, তোমার মনে এতই যদি ভয় থাকে। তবে আমার যা-কিছু আছে তোমার কাছে নাহয় জামিন রাখি, যদি কিছু লোকসান করি তো কেটে নিয়ো । মেজোরানী হেসে বললেন, শোনো একবার, ছোটােরানীর কথা শোনো ! এমন লোকসান আছে যা ইহকাল-পরকালে জামিন দিয়ে উদ্ধার হয় না । আমাদের এই কথাবার্তার মধ্যে আমার স্বামী একটি কথাও বললেন না । তার খাওয়া হয়ে যেতেই তিনি বাইরে চলে গেলেন, আজকাল তিনি আর বিশ্রাম করতে ঘরের মধ্যে বসেন না । আমার অধিকাংশ দামি গয়না ছিল খাজাঞ্চির জিন্মায়। তবু আমার নিজের কাছে যা ছিল তার দাম ত্রিশ-পয়ত্ৰিশ হাজার টাকার কম হবে না। আমি সেই গয়নার বাক্স নিয়ে মেজেরানীর কাছে খুলে দিলুম ; বললুম, মেজোরানী, আমার এই গয়না রইল তোমার কাছে। এখন থেকে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার | মেজোরানী গালে হাত দিয়ে বললেন, ওমা, তুই যে অবাক করলি ! তুই কি সত্যি ভাবিস তুই আমার টাকা চুরি করবি এই ভয়ে রাত্রে আমার ঘুম হচ্ছে না ? আমি বললুম, ভয় করতেই বা দোষ কী ? সংসারে কে কাকে চেনে বলে মেজোরানী । কোথায় রাখি ঠিক নেই, তোমার গয়না পাহারা দিয়ে আমি মরি। আর কি ! চার দিকে দাসী চাকর ঘুরছে, তোমার ও গয়না তুমি নিয়ে যাও ভাই । মেজোরানীর কাছ থেকে চলে এসেই বাইরের বৈঠকখানা-ঘরে অমূল্যকে ডেকে পাঠালুম | অমূল্যর সঙ্গে সঙ্গে দেখি সন্দীপ এসে উপস্থিত । আমার তখন দেরি করবার সময় ছিল না ; আমি সন্দীপকে বললুম, অমূল্যর সঙ্গে আমার একটু বিশেষ কথা আছে, আপনাকে একবার— সদীপ কাষ্ঠহাসি হেসে বললে, অমূল্যকে আমার থেকে আলাদা করে দেখ না কি ? তুমি যদি আমার কাছ থেকে ওকে ভাঙিয়ে নিতে চাও তা হলে আমি ওকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না । আমি এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইলুম ; সন্দীপ বললে, আচ্ছা বেশ, অমূল্যর সঙ্গে তোমার বিশেষ কথা শেষ করে নিয়ে তার পরে আমার সঙ্গে ও একটু বিশেষ কথা কবার অবসর দিতে হবে কিন্তু, নইলে আমার হার হবে । আমি সব মানতে পারি, হার মানতে পারি। নে । আমার ভাগ সকলের ভাগের বেশি । এই নিয়ে চিরজীবন বিধাতার সঙ্গে লড়ছি । বিধাতাকে হারাব, আমি হারব না । তীব্ৰ কটাক্ষে অমূল্যকে আঘাত করে সন্দীপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অমূল্যকে বললুম, লক্ষ্ম ভাই আমার, তোমাকে একটি কাজ করে দিতে হবে । সে বললে, তুমি যা বলবে আমি প্রাণ দিয়ে করুক দিদি ৷ শালের ভিতর থেকে গয়নার বাক্স বের করে তার সামনে রেখে বললুম, আমার এই গয়না বন্ধক