পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে ᏩᏄᏬ বড়ো অহংকার করে বলেছিলুম, অমূল্যকে বীচাব। যে নিজে তলিয়ে যাচ্ছে সে নাকি অন্যকে বঁচাতে পারে! হায় হায়, আমিই বুঝি ওকে মারলুম। ভাই আমার, আমি তোর এমনি দিদি, যেদিন মনে মনে তোর কপালে ভাইফোঁটা দিলুম। সেই দিনই বুঝি যম মনে মনে হাসলে! আমি যে অকল্যাণের বোঝাই নিয়ে ফিরছি আজ। আমার আজ মনে হচ্ছে মানুষকে এক-এক সময়ে যেন অমঙ্গলের প্লেগে ধরে, হঠাৎ কোথা হতে । তার বীজ এসে পড়ে তার এক রাত্রেই মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। সেই সময়ে সকল সংসার থেকে খুব দূরে কোথাও তাকে সরিয়ে রাখা যায় না কি ? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তার ছোয়াচ যে বড়ো ভয়ানক। সে যে বিপদের মশালের মতো, নিজে পুড়তে থাকে সংসারে আগুন লাগাবার জন্যেই। নটা বাজল। আমার কেমন বােধ হচ্ছে, অমূল্য বিপদে পড়েছে, ওকে পুলিসে ধরেছে। আমার গয়নার বাক্স নিয়ে থানায় গোলমাল পড়ে গেছে- কার বাক্স, ও কোথা থেকে পেলে, তার জবাব তো শেষ কালে আমাকেই দিতে হবে। সমস্ত পৃথিবীর লোকের সামনে কী জবাবটা দেব ? মেজোরানী, এতকাল তোমাকে বড়ো অবজ্ঞাই করেছি। আজ তোমার দিন এল। তুমি আজ সমস্ত পৃথিবীর রূপ ধরে শোধ তুলবে। হে ভগবান, এইবার আমাকে বীচাও, আমার সমস্ত অহংকার ভাসিয়ে দিয়ে মেজোরানীর পায়ের তলায় পড়ে থাকব! - আর থাকতে পারলুম না, তখনই বাড়ি-ভিতরে মেজোরানীর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলুম। তিনি তখন বারান্দায় রোদদূরে বসে পান সাজছেন, পাশে থাকো বসে। থাকোকে দেখে মুহূর্তের জন্যে মনটা সংকুচিত হল ; তখনই সেটা কাটিয়ে নিয়ে মেজোরানীর পায়ের কাছে পড়ে তীর পায়ের ধুলো নিলুম। : তিনি বলে উঠলেন, ও কী লো ছোটােরানী, তোর হল কী ? হঠাৎ এত ভক্তি কেন ? আমি বললুম, দিদি, আজ আমার জন্মতিথি । অনেক অপরাধ করেছি— করো দিদি, আশীর্বাদ করো, আর যেন কোনোদিন তোমাদের কোনো দুঃখ না দিই। আমার ভারি ছোটাে মন । বলেই তাকে আবার প্রণাম করে তাড়াতাড়ি উঠে এলুম। তিনি পিছন থেকে বলতে লাগলেন, বলি ও ছুটু, তোর জন্মতিথি, এ কথা আগে বলিস নি কেন ? আমার এখানে দুপুর বেলা তোর নেমস্তন্ন রইল। লক্ষ্মী বোন, ভুলিস নে । ভগবান এমন-কিছু করো যাতে আজ আমার জন্মতিথি হয়। একেবারে নতুন হতে পারি নেকি ? সব ধুয়ে-মুছে আর-একবার গোড়া থেকে পরীক্ষা করো প্ৰভু ! বাইরে বৈঠকখানা-ঘরে যখন ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় সেখানে আজ সন্দীপ এসে উপস্থিত হল। বিতৃষ্ণায় সমস্ত মনটা যেন বিষিয়ে উঠল। আজ সকালের আলোয় তার যে মুখ দেখলুম তাতে প্রতিভার জাদু একটুও ছিল না। আমি বলে উঠলুম, আপনি যান। এখান থেকে। সন্দীপ হেসে বললে, অমূল্য তো নেই, এবারে বিশেষ কথার পালা যে আমার। পোড়া কপাল! যে অধিকার আমিই দিয়েছি সে অধিকার আজ ঠেকাই কী করে ! বললুম, আমার একলা থাকবার দরকার আছে। রানী, আর-একজন লোক ঘরে থাকলেও একলা থাকার ব্যাঘাত হয় না। আমাকে তুমি মনে কোরো না ভিড়ের লোক, আমি সন্দীপ, লক্ষ লোকের মাঝেও আমি একলা । আপনি আর-এক সময় আসবেন, আজ সকালে আমিঅমূল্যের জন্যে অপেক্ষা করছেন ? আমি বিরক্ত হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করছি এমন সময় সন্দীপ তার শালের ভিতর থেকে আমার গয়নার বাক্স বের করে ঠক করে পাথরের টেবিলের উপর রাখলে। ] আমি চমকে উঠলুম ; বললুম, তা হলে অমূল্য যায় নি ? কোথায় যায় নি ? ) কলকাতায় ? সদীপ একটু হেসে বললে, না।