পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(A8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বাঁচলুম। আমার ভাইফোটা বাঁচল। আমি চাের, বিধাতার দণ্ড ঐ পর্যন্তই পীেছক— অমূল্য রক্ষা পাক । সন্দীপ আমার মুখের ভাব দেখে বিদ্রুপ করে বললে, এত খুশি রানী ? গয়নার বাক্সর এত দাম ? আবার কি ফিরিয়ে নিতে চাও ? অহংকার মরতে মরতেও ছাড়ে না ; ইচ্ছে হল দেখিয়ে দিই, এ গয়নার পরে আমার সিকি পয়সার মমতা নেই। আমি বললুম, এ গয়নায় আপনার যদি লোভ থাকে নিয়ে যান-না ! সন্দীপ বললে, আজ বাংলাদেশে যেখানে যত ধন আছে সমস্তর পরেই আমার লোভ | লোভের মতো এত বড়ো মহৎ বৃত্তি কি আর-কিছু আছে % পৃথিবীর যারা ইন্দ্ৰ লোভ তাদের ঐরাবত – তা হলে এ সমস্ত গয়না আমার ? এই বলে সন্দীপ বাকুটি তুলে নিয়ে শালের মধ্যে ঢাকা দিতেই অমূল্য ঘরের মধ্যে ঢুকল । তার চােখের গোড়ায় কালি পড়েছে, মুখ শুকনো, উষ্ক খুষ্ক চুল ; একদিনেই তার তরুণ-বয়েসের লবণা যেন ঝরে গিয়েছে । তাকে দেখবামাত্রই আমার বুকের ভিতরটায় কামড়ে উঠল । অমুলা আমার দিকে না তাকিয়েই একেবারে সনদীপকে গিয়ে বললে, আপনি গয়নার বাকু আমার তোরঙ্গ থেকে বের করে এনেছেন % না, কিন্তু তোরঙ্গ আমার } সন্দীপ হা হা করে হেসে উঠল । বললে, তোরঙ্গ সম্বন্ধে আমি-তুমি ভেদবিচার তো তোমার বড়ো সূক্ষ্ম হে অমূল্য ! তুমিও মরবার আগে ধর্মপ্রচারক হয়ে মরবে দেখছি। অমূল্য চৌকির উপর বসে পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে টেবিলের উপর মাথা রাখলে ! আমি তার কাছে এসে তার মাথায় হাত রেখে বললুম, অমূল্য, কী হয়েছে ? তখনই সে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, দিদি, এ গয়নার বাক্স আমিই নিজের হাতে তোমাকে এনে দেব এই আমার সাধ ছিল, সন্দীপবাবু তা জানতেন, তাই উনি তাড়াতাড়ি— আমি বললুম, কী হবে আমার ঐ গয়নার বাক্স নিয়ে ? ও যাক-না, তাতে ক্ষতি কী % অমূল্য বিস্মিত হয়ে বললে, যাবে কোথায় ? সন্দীপ বললে, এ গয়না আমার, এ আমার রানীর দেওয়া অৰ্ঘ্য । অমূল্য পাগলের মতো বলে উঠল, না না না, কখনোই না ! দিদি, এ আমি তোমাকে ফিরিয়ে এনে দিয়েছি, এ তুমি আর কাউকে দিতে পারবে না । আমি বললুম, ভাই, তোমার দান চিরদিন আমার মনে রইল, কিন্তু গয়নায় যার লোভ সে নিয়ে যাক-না ! অমূল্য তখন হিংস্র জন্তুর মতো সন্দীপের দিকে তাকিয়ে গুমরে গুমরে বললে, দেখুন সন্দীপবাবু, আপনি জানেন, আমি ফাসিকে ভয় করি নে । এ গয়নার বাক্স যদি আপনি নেন সন্দীপ বিদ্রুপের হাসি হাসবার চেষ্টা করে বললে, অমূল্য, তোমারও এতদিনে জানা উচিত তোমার শাসনকে আমি ভয় করি নে ; মাক্ষীরানী, এ গয়না আজ আমি নেব বলে আসি নি, তোমাকে দেব বলেই এসেছিলুম। কিন্তু আমার জিনিস তুমি যে অমূল্যর হাত থেকে নেবে সেই অন্যায় নিবারণ করবার জন্যেই প্রথমে এ বাক্সে আমার দাবি স্পষ্ট করে তোমাকে দিয়ে বলিয়ে নিলুম। এখন আমার এই জিনিস তোমাকে আমি দান করছি । এই রইল। এবারে ঐ বালকের সঙ্গে তুমি বোঝাপড়া করো, আমি চললুম। কিছুদিন থেকে তোমাদের দুজনের মধ্যে বিশেষ কথা চলছে, আমি তার মধ্যে নেই, যদি কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটে ওঠে আমাকে দোষ দিতে পারবে না। অমূল্য, তোমার তোরঙ্গ বই প্রভৃতি যা-কিছু আমার ঘরে ছিল সমস্তই বাজারে তোমার বাসাঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার ঘরে তোমার কোনো জিনিস রাখা চলবে না |