পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ ዓ\ኃ রবীন্দ্র-রচনাবলী বললে, দেখো, যদি আমার কোনো বাক্সয় সে গিনি থাকে তো নিয়ে যাও । বলে আমার গায়ের উপর চাবির গোছােটা ফেলে দিলে। কোথাও নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কোথায় রেখেছেন বলুন। সন্দীপ বললে, আগে তোমার মোহ ভাঙবে, তার পরে আমি বলব। এখন নয়।— আমি দেখলুম, কিছুতেই তাকে নড়াতে পারব না, তখন আমাকে অন্য উপায় নিতে হয়েছিল। এর পরেও ওকে এই ছ হাজার টাকার নোট দেখিয়ে সেই গিনি-কটা নেবার অনেক চেষ্টা করেছি। গিনি এনে দিচ্ছি বলে । আমাকে ভুলিয়ে রেখে ওর শোবার ঘর থেকে আমার তোরঙ্গ ভেঙে গয়নার বাক্স নিয়ে তোমার কাছে এসেছে ! এ বাক্স তোমার কাছে আমাকে নিয়ে আসতে দিলে না ! আবার বলে কিনা, এ গয়না ওরই দান ? আমাকে যে কতখানি বঞ্চিত করেছে সে আমি কাকে বলব ! এ আমি কখনো মাপ করতে পারব না । দিদি, ওর মন্ত্র একেবারে ছুটে গেছে। তুমিই ছুটিয়ে দিয়েছ। আমি বললুম, ভাই আমার, আমার জীবন সার্থক হয়েছে। কিন্তু অমূল্য, এখনো বাকি আছে। শুধু মায়া কাটালে হবে না, যে কালি মেখেছি সে ধুয়ে ফেলতে হবে । দেরি কোরো না অমূল্য, এখনই যাও, এ টাকা যেখান থেকে এনেছ সেইখানেই রেখে এসো | পারবে না লক্ষ্মী ভাই ? তোমার আশীর্বাদে পারব দিদি । এ শুধু তোমার একলার পারা নয় । এর মধ্যে যে আমারও পারা আছে । আমি মেয়েমানুষ, বাইরের রাস্তা আমার বন্ধ, নইলে তোমাকে আমি যেতে দিতুম না, আমিই যৌতুম। আমার পক্ষে এইটেই সব চেয়ে কঠিন শাস্তি যে, আমার পাপ তোমাকে সামলাতে হচ্ছে । ও কথা বোলো না দিদি । যে রাস্তায় চলেছিলুম, সে তোমার রাস্তা নয়। সে রাস্তা দুৰ্গম বলেই আমার মনকে টেনেছিল । দিদি, এবার তোমার রাস্তায় ডেকেছ- এ রাস্তা আমার আরো হাজার গুণে দুৰ্গম হােক, কিন্তু তোমার পায়ের ধুলো নিয়ে জিতে আসব, কোনো ভয় নেই। তা হলে এ টাকা যেখান থেকে এনেছি সেইখানেই ফিরিয়ে দিতে হবে এই তোমার হুকুম ? আমার হুকুম নয় ভাই, উপরের হুকুম | সে আমি জানি নে সেই উপরের হুকুম তোমার মুখ দিয়ে এসেছে এই আমার যথেষ্ট । কিন্তু দিদি, তোমার কাছে আমার নেমস্তেন্ন আছে । সেইটে আজ আদায় করে তবে যাব | প্ৰসাদ দিতে হবে । তার পরে সন্ধের মধ্যেই যদি পারি কাজ সেরে আসব | হাসতে গিয়ে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে পড়ল ; বললুম, আচ্ছা ! অমূল্য চলে যেতেই আমার বুক দমে গেল। কোন মায়ের বাছাকে বিপদে ভাসালুম ! ভগবান, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত এমন সর্বনেশে ঘটা করে কেন ! এত লোককে নিমন্ত্রণ ! আমার একলায় কুলোল না ? এত মানুষকে দিয়ে তার ভার বহন করবে ! আহা, ঐ ছেলেমানুষকে কেন মারবে ? তাকে ফিরে ডাকলুম, অমূল্য ! আমার গলা এমন ক্ষীণ হয়ে বাজল সে শুনতে পেলে না। দরজার কাছে গিয়ে আবার ডাকলুম, অমূল্য ! তখন সে চলে গেছে। বোহারা, বেহারিা ! কী রানীমা ? অমূল্যবাবুকে ডেকে দে । কী জানি, বেহারা অমূল্যর নাম বােধ হয় জানে না, তাই সে একটু পরেই সন্দীপকে ডেকে নিয়ে এল। ঘরে ঢুকেই সন্দীপ বললে, যখন তাড়িয়ে দিলে তখনই জানতুম ফিরে ডাকবে। যে চাঁদের টানে ভাটা সেই চাদের টানেই জোয়ার । এমনি নিশ্চয় জানতুম তুমি ডাকবে যে, আমি দরজার কাছে অপেক্ষা করে বসেছিলুম। যেমনি তোমার বেহারাকে দেখেছি আমনি সে কিছু বলবার পূর্বেই তাড়াতাড়ি বলে উঠলুম, আচ্ছা, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, এখনই যাচ্ছি। ভোজপুরীটা আশ্চর্য হয়ে ই করে রইল। ভাবলে লোকটা মন্ত্রসিদ্ধ। মক্ষীরানী, সংসারে সব চেয়ে বড়ো লড়াই এই মন্ত্রের লড়াই ।