পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܓbr?) পিঠের পরে পিঠে ভাঁজছি, বিশ্রাম নেই। এক-একবার মনে হচ্ছে যেন উপরে আমার মহলের দিকে কী-একটা গোলমাল চলছে। হয়তো আমার স্বামী লোহার সিন্দুক খুলতে এসে চাবি খুঁজে পাচ্ছেন না । তাই নিয়ে মেজোরানী দাসী-চাকরকে ডেকে একটা তোলপাড় কাণ্ড বাধিয়েছেন । না, আমি শুনব না, কিছু শুনব না, দরজা বন্ধ করে থাকব। দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি থাকো তাড়াতাড়ি আসছে ; সে হাঁপিয়ে বললে, ছোটােরানীমা ! আমি বলে উঠলুম, যা যা, বিরক্ত করিস নে আমার এখন সময় নেই।— থাকো বললে, মেজোরানীমা'র বোনপো নন্দবাবু কলকাতা থেকে এক কল এনেছেন, সে মানুষের মতো গান করে, তাই মেজোরানীমা তোমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন । হাসব কি কঁদব তাই ভাবি । এর মাঝখানেও গ্রামোফোন | তাতে যতবার দম দিচ্ছে সেই থিয়েটারের নাকি সুর বেরোচ্ছে ; ওর কোনো ভাবনা নেই ; যন্ত্র যখন জীবনের নকল করে তখন তা এমনি বিষম বিদ্যুপ হয়েই ওঠে । সন্ধা হয়ে গেল । জানি, অমূল্য এলেই আমাকে খবর পাঠাতে দেরি করবে না ; তবু থাকতে পারলুম না, বেহারাকে ডেকে বললুম, অমূল্যবাবুকে খবর দাও । বেহােরা খানিকটা ঘুরে এসে বললে, কথাটা কিছুই নয়, কিন্তু হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে যেন তোলপাড় করে উঠল । অমূল্যবাবু নেই— সেই সন্ধার অন্ধকারে এ কথাটা যেন কান্নার মতো বাজল ; নেই, সে নেই । সে সর্যাস্তের সোনার রেখাটির মতো দেখা দিলে, তার পরে সে আর নেই ! সম্ভব অসম্ভব কত দুর্ঘটনার কল্পনাই আমার মাথার মধ্যে জমে উঠতে লািগল । আমিই তাকে মৃত্যুর মধ্যে পাঠিয়েছি, সে যে কোনো ভয় করে নি সে তারই মহত্ত্ব, কিন্তু এর পরে আমি বেঁচে থাকিব কেমন করে ? অমূল্যর কোনো চিহ্নই আমার কাছে ছিল না ; কেবল ছিল তার সেই ভাইফোর্টার প্রণামী, সেই পিস্তলটি ; মনে হল এর মধ্যে দৈবের ইঙ্গিত রয়েছে । আমার জীবনের মূলে যে কলঙ্ক লেগেছে, বালক-বেশে আমার নারায়ণ সেটি ঘুচিয়ে দেবার উপায় আমার হাতে রেখে দিয়েই কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছেন । কী ভালোবাসার দান ! কী পাবনমন্ত্র তার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ! বাক্স খুলে পিস্তলটি বের করে দুই হাতে তুলে আমার মাথায় ঠেকালুম । ঠিক সেই মূহুর্তেই আমাদের ঠাকুরবাড়ি থেকে আরতির কাসর ঘণ্টা বেজে উঠল । আমি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্ৰণাম করলুম। রাত্রে লোকজনদের পিঠে খাওয়ানো গেল । মেজোরানী এসে বললেন, নিজে নিজেই খুব ধুম করে তিথি করে নিলি যা হোক। আমাদের বুঝি কিছু করতে দিবি নে ? এই বলে তিনি তার সেই গ্রামোফোনটাতে যত রাজ্যের নটীদের মিহি চড়া সুরের দ্রুত তানের কসরত শোনাতে লাগলেন ; মনে হতে লািগল যেন গন্ধৰ্ব্বলোকের সুরওয়ালা ঘোড়ার আস্তাবল থেকে চিহি চিহি শব্দে হেযাধনি উঠছে | খাওয়ানো শেষ করতে অনেক রাত হয়ে গেল ! ইচ্ছা ছিল আজ রাতে আমার স্বামীর পায়ের ধূলো নেব । শোবার ঘরে গিয়ে দেখি তিনি অকাতরে ঘুমোচ্ছেন । আজ সমস্ত দিন তার অনেক ঘোরাঘুরি অনেক ভাবনা গিয়েছে। খুব সাবধানে মশারি একটুখানি খুলে তার পায়ের কাছে আস্তে আস্তে মাথা রাখলাম : চুলের স্পর্শ লাগতেই ঘুমের ঘোরে তিনি তার পা দিয়ে আমার মাথাটা একটু ঠেলে দিলেন । পশ্চিমের বারান্দায় গিয়ে বসলুম ! দূরে একটা শিমুল গাছ। অন্ধকারে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে ; তার সমস্ত পাতা ঝরে গিয়েছে, তারই পিছনে সপ্তমীর চাদ ধীরে ধীরে অস্ত গেল । আমার হঠাৎ মনে হল আকাশের সমস্ত তারা যেন আমাকে ভয় করছে, রাত্ৰিবেলাকার এই প্ৰকাণ্ড জগৎ আমার দিকে যেন আড়ােচাখে চাইছে । কেননা আমি যে একলা ; একলা মানুষের মতো এমন সৃষ্টিছাড়া আর কিছুই নেই। যার সমস্ত আত্মীয়স্বজন একে একে মরে গিয়েছে সেও একলা নয়, মৃত্যুর আড়াল থেকেও সে সঙ্গ পায়। কিন্তু যার সমস্ত আপন মানুষ পাশেই রয়েছে, তবু কাছে নেই, যে মানুষ পরিপূর্ণ সংসারের সকল অঙ্গ থেকেই একেবারে খসে পড়ে গিয়েছে, মনে হয় যেন অন্ধকারে তার মুখের দিকে চাইলে সমস্ত নক্ষত্ৰলোকের গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে । আমি যেখানে রয়েছি ༣