পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Qbr8 রবীন্দ্র-রচনাবলী নিখিলেশের আত্মকথা আজ আমরা কুলকাতায় যাব । সুখদুঃখ কেবলই জমিয়ে তুলতে থাকলে বোঝা ভারী হয়ে ওঠে। কেননা বসে থাকাটা মিথ্যে, সঞ্চয় করাটা মিথ্যে । আমি যে এই ঘরের কর্তা এটা বানানো জিনিস, সত্য এই যে, আমি জীবনপথের পথিক । ঘরের কর্তাকে তাই বারেবারে ঘা লাগবে, তার পরে শেষ আঘাত আছে মৃত্যু। তোমার সঙ্গে আমার যে মিলন সে মিলন চলার মুখে ; যতদূর পর্যন্ত এক পথে চলা গেল ততদূর পর্যন্তই ভালো, তার চেয়ে বেশি টানাটানি করতে গেলেই মিলন হবে বাধন । সে বঁাধন আজ রইল পড়ে ; এবার বেরিয়ে পড়লুম, চলতে চলতে যেটুকু চােখে চােখে মেলে, হাতে হাতে ঠেকে সেইটুকুই ভালো । তার পরে ? তার পরে আছে অনন্ত জগতের পথ, অসীম জীবনের বেগ— তুমি আমাকে কতটুকু বঞ্চনা করতে পারো প্রিয়ে ? সামনে যে বাঁশি বাজছে কান দিয়ে যদি শুনি তো শুনতে পাই, বিচ্ছেদের সমস্ত ফাটলগুলোর ভিতর দিয়ে তার মাধুর্যের ঝন ঝরে পড়ছে। লক্ষ্মীর ভাঙা পাত্র কুড়োতে যাব না, আমি আমার অতৃপ্তি বুকে নিয়েই সামনে চলে যাব । মেজোরানীদিদি এসে বললেন, ঠাকুরপো, তোমার বইগুলো সব বাক্স ভরে গোরুর গাড়ি বোঝাই করে যে চলল তার মানে কী বলে তো ? আমি বললুম, তার মানে ঐ বইগুলোর উপর থেকে এখনো মায়া কাটাতে পারি নি । মায়া কিছু কিছু থাকলেই যে বাচি । কিন্তু, এখানে আর ফিরবে না নাকি ? আনাগোনা চলবে, কিন্তু পড়ে থাকা আর চলবে না । সত্যি নাকি ? তা হলে একবার এসো, একবার দেখো সে কত জিনিসের উপরে আমার মায়া |—— এই বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন । তার ঘরে গিয়ে দেখি ছোটােবড়ো নানা রকমের বাক্স আর পুঁটলি। একটা বাক্স খুলে দেখালেন, এই দেখো ঠাকুরপো আমার পান-সাজাের সরঞ্জাম ; কেয়াখয়ের গুড়িয়ে বোতলের মধ্যে পুরেছি ; এই সব দেখছ এক-এক-টিন মসলা } এই দেখো তাস, দশ-পঁচিশও ভুলি নি, তোমাদের না পাই আমি খেলবার লোক জুটিয়ে নেবই । এই চিরুনি তোমারই স্বদেশী চিরুনি, আর এই— কিন্তু ব্যাপারটা কী মেজোরানী ? এ-সব বাক্সয় তুলেছ কেন ? আমি যে তোমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাচ্ছি। সে কী কথা ? ভয় নেই ভাই, ভয় নেই, তোমার সঙ্গেও ভাব করতে যাব না, ছোটোরানীর সঙ্গেও ঝগড়া করব না ! মরতেই তো হবে, তাই সময় থাকতে গঙ্গাতীরের দেশে আশ্রয় নেওয়া ভালো | ম’লে তোমাদের সেই নেড়া-বটতলায় পোড়াবে সে কথা মনে হলে আমার মরতে ঘেন্না ধরে, সেইজন্যেই তো এতদিন ধরে তোমাদের জ্বালাচ্ছিা! এতক্ষণ পরে আমার এই বাড়ি যেন কথা কয়ে উঠল । আমার বয়স যখন ছয় তখন ন বছর বয়সে মেজোরানী আমাদের এই বাড়িতে এসেছেন । এই বাড়ির ছাদে দুপুরবেলায় উচু পাচিলের কোণের ছায়ায় বসে ওঁর সঙ্গে খেলা করেছি। বাগানে আমড়াগাছে চড়ে উপর থেকে কঁচা আমড়া ফেলেছি, তিনি নীচে বসে সেগুলি কুচি-কুচি করে তার সঙ্গে নুন লঙ্কা ধনেশাক মিশিয়ে অপথ্য তৈরি করেছেন । পুতুলের বিবাহের ভোজ উপলক্ষে যে-সব উপকরণ ভাড়ার-ঘর থেকে গোপনে সংগ্ৰহ করার প্রয়োজন ছিল তার ভার ছিল আমারই উপরে, কেননা ঠাকুরমার বিচারে আমার কোনো অপরাধের দণ্ড ছিল না । তার পরে যে-সব শৌখিন জিনিসের জন্যে দাদার 'পরে তার আবদার ছিল সে আবদারের বাহক ছিলুম। আমি ; আমি দাদাকে বিরক্ত করে করে যেমন করে হোক কাজ উদ্ধার করে আনতুম |