পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

@brや রবীন্দ্র-রচনাবলী দুপুরবেলায় একটু ঘুমিয়ে নিয়ো ; গাড়িতে রাত্তিরে তো ভালো ঘুম হবে না। তোমার শরীর এমন হয়েছে দেখলেই মনে হয়, আর-একটু হলেই ভেঙে পড়বে | চলো, এখনই তোমাকে নাইতে যেতে হবে । এমন সময় ক্ষেমা মস্ত একটা ঘোমটা টেনে মৃদুস্বরে বললে, দারোগীবাবু কাকে সঙ্গে করে এনেছে, মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে চায় । মেজোরানী রাগ করে উঠে বললেন, মহারাজ চোর না ডাকাত যে দারোগা তার সঙ্গে লেগেই রয়েছে। বলে আয় গে, মহারাজ এখন নাইতে গেছেন । আমি বললুম, একবার দেখে আসি গে, হয়তো কোনাে জরুরি কাজ আছে। । মেজোরানী বললেন, না, সে হবে না । ছোটােরানী কাল বিস্তর পিঠে তৈরি করেছে, দারোগীকে সেই পিঠে খেতে পাঠিয়ে তার মেজাজ ঠাণ্ডা করে রাখছি। । বলে তিনি আমাকে হাতে ধরে টেনে স্নানের ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন । আমি ভিতর থেকে বললুম, আমার সাফ কাপড় যে এখনো— তিনি বললেন, সে আমি ঠিক করে রাখব, ততক্ষণ তুমি স্নান করে নাও । এই উৎপাতের শাসনকে অমানা করি এমন সাধ্য আমার নেই ; সংসারে এ যে বড়ো দুর্লভ। থাক গে, দারোগীবাবু বসে বসে পিঠে খাক গে। নাহয় হল আমার কাজের অবহেলা । ইতিমধ্যে সেই ডাকাতি নিয়ে দারোগ দু-পাচ জনকে ধরা-পাকড়া করছেই । রোজই একটা-না-একটা নিরীহ লোককে ধরে বেঁধে এনে আসর গরম করে রেখেছে । আজও বোধ হয় তেমনি কোন-এক অভাগাকে পাকড়া করে এনেছে। কিন্তু পিঠে কি একলা দারোগই খাবে ? সে তো ঠিক নয়। দরজায় দমাদম ঘা লাগালুম | মেজোরানী বাইরে থেকে বললেন, জল ঢালো, জল ঢালো, মাথা গরম হয়ে উঠেছে বুঝি ? আমি বললুম, পিঠে দুজনের মতো সাজিয়ে পাঠিয়ে ; দারোগ যাকে চোর বলে ধরেছে পিঠে তারই প্ৰাপ্য, বেহারাকে বলে দিয়ে তার ভাগে যেন বেশি পড়ে । যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি স্নান সেরেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলুম। দেখি দরজার বাইরে মাটির উপরে বিমল বসে ! এ কি আমার সেই বিমল, সেই তেজে অভিমানে ভরা গরবিনী ! কোন ভিক্ষা মনের মধ্যে নিয়ে এ আমার দরজাতেও বসে থাকে ! আমি একটু থমকে দাঁড়াতেই সে উঠে মুখ একটু নিচু করে আমাকে বললে, তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে | আমি বললুম, তা হলে এসো আমাদের ঘরে । হী, কিন্তু থাক সে কাজ, আগে তোমার সঙ্গে— না, তুমি কাজ সেরে এসো, তার পরে তোমার খাওয়া হলে কথা হবে । বাইরে গিয়ে দেখি দারোগার পাত্র শূন্য। সে যাকে ধরে এনেছে সে তখনো বসে বসে পিঠে খাচ্ছে । আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, এ কী, অমূল্য যে ! সে এক-মুখ পিঠে নিয়ে বললে, আজ্ঞে ই ! পেট ভরে খেয়ে নিয়েছি, এখন কিছু যদি না মনে করেন তা হলে যে কটা বাকি আছে রুমালে বেঁধে নিই। বলে পিঠেগুলো সব রুমালে বেঁধে নিলে । আমি দারোগার দিকে চেয়ে বললুম, ব্যাপারখানা কী ? দারোগা হেসে বললে, মহারাজ, চোরের হেঁয়ালি তো হেঁয়ালিই রয়ে গেছে, তার উপরে চোরাই মালের হেঁয়ালি নিয়ে মাথা ঘোরাচ্ছি।