পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ব্যঙ্গকৌতুক Ved è সনাতন টাকশাল হইতে বাহির হইয়াছি যেন মনেও নাই। এই পর্যন্ত অবগত আছি যে, ব্ৰহ্মার পা হইতে যেমন শূদ্রের উৎপত্তি সেইরূপ টাকশালের অত্যন্ত নিম্নবিভাগেই আমাদের জন্ম। সেদিন সিকি দু-আনির একটা মহতী সভা বসিবে কাগজে এইরূপ একটা বিজ্ঞাপন পড়া গিয়াছিল। হাতে কাজ ছিল না, কৌতুহলবশত গড়াইয়া গড়াইয়া সেই সভায় গিয়া উপস্থিত হইলাম এবং দেয়ালের কাছে একটা কোণে আশ্রয় লইলাম । সুকুমারী সহধর্মিণী দু-আনিকে সযত্নে বামপার্থে লইয়া শুভ্রকায় চার-আনিগুলি দলে দলে আসিয়া সভাগৃহ আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। তাহারা বাস করে কেহ বা কোটের পকেট, কেহ বা চামড়ার থলিতে, কেহ-বাটিনের বাক্সে। কেহ কেহ বা অদৃষ্টগতিকে আমাদের প্রতিবেশীরূপে আমাদের পাড়ায় ট্যাকের মধ্যেও বদ্ধ হইয়া দিনযাপন করে । সেদিনকার আলোচনার বিষয়টা এই যে, আমরা পয়সার সহিত সর্বতোভাবে পৃথক হইতে চাহি, কারণ, উহারা বড়োই হীন। দু-আনিরা সুতীক্ষ উচ্চস্বরে কহিল, এবং উহারা তাম্রবর্ণ ও উহাদের গন্ধ ভালো নহে। আমার পাশে একটি দু-আনি ছিল, সে ঈষৎ বাকিয়া বসিয়া নাসাগ্র কুঞ্চিত করিল, তাহার পার্শ্ববতী চার-আনি আমার দিকে কট্রমটু করিয়া তাকাইল, আমি তো একেবারে সংকোচে সিকিপয়সা হইয়া গেলাম। মনে মনে কহিলাম, আমাদেরই তো আটটা ষোলোটা হজম করিয়া তোমাদের আজ এত মূল্য, সেজন্য কি কিছু কৃতজ্ঞতা নাই ? মাটির নীচে তো উভয়ের সমান পদবী ছিল। সেদিন প্রস্তুব হইল গীেরমুদ্রা এবং তাম্রমুদ্রার জন্য স্বতন্ত্র টাকশাল স্থাপিত হউক। যদিও এক মহারানীর ছাপ উভয়ের উপর মারা হইয়াছে, তাই বলিয়া কোনোরূপ সাম্য আমরা স্বীকার করিতে চাহি না। আমরা এক ট্যাক, এক থলি, এক বাক্সে বাস করিব না। এমনকি, সিকি দু-আনি ভাঙাইয়া পয়সা করা ও পয়সা ভাঙাইয়া সিকি দু-আনি করা এরূপ অপমানজনক আইনও আমরা পরিবর্তন করিতে “ চাহি । সাম্যবাদের গৌরব আমরা অস্বীকার করি না, কিন্তু তাহার একটা সীমা আছে। গিনি মোহরের সহিত সিকি দু-আনি এক সাম্যসীমার অন্তর্গত, কিন্তু তাই বলিয়া সিকি দু-আনির সহিত পয়সা ! সকলেই চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, কখনোই নহে! কখনোই নহে! দু-আনির তীব্র কণ্ঠস্বর সর্বোচে শোনা গেল । যে খনিতে আমার আদিম উৎপত্তি সেই খনির মধ্যে প্ৰবেশ করিবার ইচ্ছায় আমি বসুমতীকে দ্বিধা হইতে অনুরোধ করিলাম, বসুমতী সে অনুরোধ পালন করিল না— দেয়াল ঘেষিয়া রক্তবর্ণ হইয়া দাড়াইয়া রহিলাম। এমন সময় এক ঝকঝকে নূতন সিকি গড়াইয়া এই সিকি দু-আনির সভার মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। সে দেখিলাম সকলকে ছাড়াইয়া উঠিল। সতেজে বক্তৃতা দিতে লাগিল, ঝন ঝন শব্দে চারি দিকে করতালি পড়িল । কিন্তু আমি ঠাহর করিয়া শুনিলাম, বক্তৃতাটা যেমন হউক আওয়াজটা ঠিক রূপালি ছাদের নহে। মনে বড়ো সন্দেহ হইল। সভা যখন ভঙ্গ হইল, ধীরে ধীরে গড়াইয়া গড়াইয়া বহুসাহসপূর্বক তাহার গায়ের উপর গিয়া পড়িলাম- ঠন করিয়া আওয়াজ হইল, সে আওয়াজটা অত্যন্ত দিশি এবং গন্ধটাও । দেখিলাম আমাদের স্বজাতীয়ের মতো। মহা রাগিয়া উঠিয়া সে কহিল, তুমি কোথাকার অসভ্য হে! আমি কহিলাম, বৎস, তুমিও যেখানকার আমিও সেখানকার। ছোড়াটা আমাদের নিম্নতম কুটুম্ব— আধ-পয়সা ; কোথা হইতে পারা মাখিয়া আসিয়াছে। তাহার রকম সকম দেখিয়া হাহাঃ শব্দে হাসিয়া উঠিলাম। : হাসির শব্দে জাগিয়া উঠিয়া দেখি, স্ত্রী পাশে শুইয়া কঁদিতেছে। তৎক্ষণাৎ তাহার সঙ্গে ভােব করিয়া লইলাম। ঘটনাটা আদ্যোপােন্ত বিবৃত করিয়া বলিলাম, বড়ো ধরা পড়িয়াছে! কিন্তু মনে করিতেছি আমিও কাল হইতে পারা মাখিয়া . আপিসে যাইব । । আমার স্ত্রী কহিল, তাহার অপেক্ষা পারা খাইয়া মারা ভালো । SVOO