পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

じミ○ রবীন্দ্র-রচনাবলী সকল সময় এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না। যেখানে থাকে সেখানেই সোনায় সোহাগা। কবির কল্পনাসচেতন হৃদয় যতই বিশ্বব্যাপী হয় ততই তাহার রচনার গভীরতায় আমাদের পরিতৃপ্তি বাড়ে। ততই মানববিশ্বের সীমা বিস্তারিত হইয়া আমাদের চিরন্তন বিহারক্ষেত্র বিপুলতা লাভ করে। কিন্তু রচনাশক্তির নৈপুণ্যও সাহিত্যে মহামূল্য। কারণ, যাহাকে অবলম্বন করিয়া সে শক্তি প্রকাশিত হয় তাহা অপেক্ষাকৃত তুচ্ছ হইলেও এই শক্তিটি একেবারে নষ্ট হয় না। ইহা ভাষার মধ্যে সাহিত্যের মধ্যে সঞ্চিত হইতে থাকে । ইহাতে মানবের প্রকাশক্ষমতা বৃদ্ধি করিয়া দেয়। এই ক্ষমতাটি লাভের জন্য মানুষ চিরদিন ব্যাকুল । যে কৃতিগণের সাহায্যে মানুষের এই ক্ষমতা পরিপুষ্ট হইতে থাকে মানুষ তাহাদিগকে যশস্বী করিয়া ঋণশোধের চেষ্টা করে। যে মানসজগৎ হৃদয়ভাবের উপকরণে অন্তরের মধ্যে সৃষ্ট হইয়া উঠিতেছে তাহাকে বাহিরে প্রকাশ করিবার উপায় কী ? তাহাকে এমন করিয়া প্রকাশ করিতে হইবে যাহাতে হৃদয়ের ভাব উদ্রিক্ত হয় । হৃদয়ের ভােব উদ্রেক করিতে সাজ-সরঞ্জাম অনেক লাগে। পুরুষ-মানুষের আপিসের কাপড় সাদাসিধা ; তাহা যতই বাহুল্যবর্জিত হয় ততই কাজের উপযোগী হয়। মেয়েদের বেশভূষা, লজ্জাশরাম ভাবভঙ্গি সমস্ত সভ্যসমাজেই প্রচলিত । মেয়েদের কাজ হৃদয়ের কাজ । তাহাদিগকে হৃদয় দিতে হয় ও হৃদয় আকর্ষণ করিতে হয় ; এইজন্য তাহাদিগকে নিতান্ত সোজাসুজি, সাদাসিধা ছাটাছোেটা হইলে চলে না । পুরুষদের যথাযথ হওয়া আবশ্যক, কিন্তু মেয়েদের সুন্দর হওয়া চাই। পুরুষের ব্যবহার মোটের উপর সুস্পষ্ট হইলেই ভালো, কিন্তু মেয়েদের ব্যবহারে অনেক আবরণ আভাস-ইঙ্গিত থাকা চাই । সাহিত্যও আপন চেষ্টাকে সফল করিবার জন্য অলংকারের, রূপকের, ছন্দের, আভাসের, ইঙ্গিতের আশ্রয় গ্রহণ করে । দর্শন-বিজ্ঞানের মতো নিরলংকার হইলে তাহার চলে না । অপরূপকে রূপের দ্বারা ব্যক্ত করিতে গেলে বচনের মধ্যে অনির্বাচনীয়তাকে রক্ষা করিতে হয় । নারীর যেমন শ্ৰী এবং হী সাহিত্যের অনির্বাচনীয়তাটিও সেইরূপ । তাহা অনুকরণের অতীত । তাহা অলংকরকে অতিক্ৰম করিয়া উঠে, তাহা অলংকারের দ্বারা আচ্ছন্ন হয় না । ভাষার মধ্যে এই ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য সাহিত্য প্রধানত ভাষার মধ্যে দুইটি জিনিস মিশাইয়া থাকে, চিত্র এবং সংগীত । কথার দ্বারা যাহা বলা চলে না। ছবির দ্বারা তাহা বলিতে হয় | সাহিত্যে এই ছবি আঁকার সীমা নাই । উপমা-তুলনা-রূপকের দ্বারা ভাবগুলি প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিতে চায়। “দেখিবারে আঁখি-পাখি ধ্যায়। এই এক কথায় বলরামদাস কী না বলিয়াছেন ? ব্যাকুল দৃষ্টির ব্যাকুলতা কেবলমাত্র বর্ণনায় কেমন করিয়া ব্যক্ত হইবে ? দৃষ্টি পাখির মতো উড়িয়া ছুটিয়াছে, এই ছবিটুকুতে প্রকাশ করিবার বহুতর ব্যাকুলতা এ ছাড়া ছন্দে শব্দে বাক্যবিন্যাসে সাহিত্যকে সংগীতের আশ্রয় তো গ্ৰহণ করিতেই হয় । যাহা কোনোমতে বলিবার জো নাই এই সংগীত দিয়াই তাহা বলা চলে । অর্থ বিশ্লেষ করিয়া দেখিলে যে কথাটা যৎসামান্য এই সংগীতের দ্বারাই তাহা অসামান্য হইয়া উঠে । কথার মধ্যে বেদনা। এই সংগীতই সঞ্চার করিয়া দেয় । । 蝎 অতএব চিত্র এবং সংগীতই সাহিত্যের প্রধান উপকরণ । চিত্র ভাবকে আকার দেয় এবং সংগীত ভাবকে গতিদান করে । চিত্ৰ দেহ এবং সংগীত প্ৰাণ । কিন্তু কেবল মানুষের হৃদয়ই যে সাহিত্যে ধরিয়া রাখিবার জিনিস তাহা নহে। মানুষের চরিত্রও এমন একটি সৃষ্টি যাহা জড়সৃষ্টির ন্যায় আমাদের ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা আয়ত্তগম্য নহে। তাহাকে দাড়াইতে বলিলে দাঁড়ায় না। তাহা মানুষের পক্ষে পরম ঔৎসুক্যজনক, কিন্তু তাহাকে পশুশালার পশুর মতো বাধিয়া খাচার মধ্যে পুরিয়া ঠাহর করিয়া দেখিবার সহজ উপায় নাই। এই ধরাবাধার অতীত বিচিত্র মানবচরিত্র, সাহিত্য ইহাকেও অন্তরলোক হইতে বাহিরে প্রতিষ্ঠিত