পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\9\OV রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বর্ণবৈচিত্র্যের চাপল্য কোথাও নাই, সে আমাদের মনকে চারি দিক হইতে এমন করিয়া ঘনাইয়া ধরে যে কোথাও যেন কিছু ফাক রাখে না। ধরণীর তাপশান্তি, শস্যক্ষেত্রে দৈন্যনিবৃত্তি, নদীসরোবরের কৃশতা-মোচনেয়। উদার আশ্বাস তাহার স্নিগ্ধ নীলিমার মধ্যে যে মাখনাে ; মঙ্গলময় পরিপূর্ণতার গভীর মাধুর্যে সে স্তব্ধ হইয়া থাকে। কালিদাস তো বসন্তের বাতাসকে বিরহী যক্ষের দৌত্যকার্যে নিযুক্ত করিতে পারিতেন । এ কার্যে র্তাহার হাতযশা আছে বলিয়া লোকে রটনা করে ; বিশেষত উত্তরে যাইতে হইলে দক্ষিণা-বাতাসকে কিছুমাত্র উজানে যাইতে হইত না। কিন্তু কবি প্রথম আষাঢ়ে নৃতন মেঘকেই পছন্দ করিলেন ; সে যে জগতের তাপ নিবারণ করে, সে কি শুধু প্রণয়ীর বার্তা প্ৰণয়িনীর কানের কাছে প্ৰলিপিত করিবে ? সে যে সমস্ত পথটার নদীগিরিকাননের উপর বিচিত্র পূর্ণতার সঞ্চার করিতে করিতে যাইবে । কদম্ব ফুটিবে, জম্বুকুঞ্জ ভরিয়া উঠিবে, বলাকা উড়িয়া চলিবে, ভরা নদীর জল ছলছল। করিয়া তাহার কুলের বেত্রবনে আসিয়া ঠেকিবে এবং জনপদবধূর ভূবিলাসহীন গ্ৰীতিস্নিগ্ধ লোচনের দৃষ্টিপাতে আষাঢ়ের আকাশ যেন আরো জুড়াইয়া যাইবে । বিরহীর বার্তাপ্রেরণকে সমস্ত পৃথিবীর মঙ্গলব্যাপারের সঙ্গে পদে পদে গাথিয়া গাথিয়া তবে কবির সৌন্দর্যরসপিপাসু চিত্ত তৃপ্তিলাভ করিয়াছে | কুমারসম্ভবের কবি অকালবসন্তের আকস্মিক উৎসবে পুষ্পশরে মোহবৰ্ষণের মধ্যে হরপার্বতীর মিলনকে চূড়ান্ত করিয়া তোলেন নাই | স্ত্রীপুরুষের উন্মত্ত সংঘাত হইতে যে আগুন জ্বলিয়া উঠিয়ছিল সেই প্রলয়াগ্নিতে আগে তিনি শান্তিধারা বর্ষণ করিয়াছেন, তবে তো মিলনের প্রতিষ্ঠা করিতে পরিলেন । কবি গীেরীর প্রেমের সর্বাপেক্ষা কমনীয় মূর্তি তপস্যার অগ্নির দ্বারাই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইয়াছেন । সেখানে বসন্তের পুষ্পসম্পদ স্নান, কোকিলের মুখরতা স্তব্ধ । অভিজ্ঞান-শকুন্তলেও প্ৰেয়সী যেখানে জননী হইয়াছেন, বাসনার চাঞ্চল যেখানে বেদনার তপস্যায় গাম্ভীৰ্যলাভ করিয়াছে, যেখানে অনুতাপের সঙ্গে ক্ষমা আসিয়া মিলিয়ছে, সেইখানেই রাজদম্পতির মিলন সার্থক হইয়াছে। প্রথম মিলনে প্ৰলয়, দ্বিতীয় মিলনেই পরিত্ৰাণ | এই দুই কাব্যেই শান্তির মধ্যে, মঙ্গলের মধ্যে, যেখানেই কবি সৌন্দর্যের সম্পূর্ণতা দেখাইয়াছেন সেখানেই তাহার তুলিকা বৰ্ণবিরল, তাহার বীণা অপ্ৰমাও ! বস্তুত সৌন্দর্য যেখানেই পরিণতিলাভ করিয়াছে সেখানেই সে আপনার প্রগলভ্যতা দূর করিয়া দিয়াছে। সেইখনেই ফুল আপনার বর্ণগন্ধের বাহুল্যকে ফলের গৃঢ়তর মাধুর্যে পরিণত করিয়াছে ; সেই পরিণতিতেই সৌন্দর্যের সহিত মঙ্গল একান্ত হইয়া উঠিয়াছে । সৌন্দর্য ও মঙ্গলের এই সম্মিলন যে দেখিয়াছে সে ভোগবিলাসের সঙ্গে সৌন্দর্যকে কখনোই জড়াইয়া রাখিতে পারে না । তাহার জীবনযাত্রার উপকরণ সাদাসিধা হইয়া থাকে ; সেটা সৌন্দর্যবোধের অভাব হইতে হয় না, প্রকর্ষ হইতেই হয় । অশোকের প্রমোদ-উদ্যান কোথায় ছিল ? তাহার রাজবাটীর ভিতের কোনো চিহ্নও তো দেখিতে পাই না । কিন্তু অশোকের রচিত স্তুপ ও স্তম্ভ বুদ্ধগয়ায় বােধিবটমূলের কাছে দাড়াইয়া আছে। তাহার শিল্পকলাও সামান্য নহে। যে পুণ্যস্থানে ভগবান বুদ্ধ মানবের দুঃখনিবৃত্তির পথ আবিষ্কার করিয়াছেন রাজচক্রবর্তী অশোক সেইখানেই, সেই পরমমঙ্গলের স্মরণক্ষেত্রেই, কলাসৌন্দর্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন । নিজের ভোগকে এই পূজার অর্ঘ্য তিনি এমন করিয়া দেন নাই। এই ভারতবর্ষে কত দুৰ্গম গিরিশিখরে কত নির্জন সমুদ্রতীরে, কত দেবালয় কত কলাশোভন পুণ্যকীর্তি দেখিতে পাই, কিন্তু হিন্দুরাজাদের বিলাসভবনের স্মৃতিচিহ্ন কোথায় গেল ? রাজধানী-নগর ছাড়িয়া অরণ্যপর্বতে এই-সমস্ত সৌন্দর্যস্থাপনের কারণ কী ? কারণ আছে। সেখানে মানুষ নিজের সৌন্দর্যসৃষ্টির দ্বারা নিজের চেয়ে বড়োর প্রতিই বিস্ময়পূর্ণ ভক্তি প্ৰকাশ করিয়াছে। মানুষের রচিত সৌন্দর্য দাড়াইয়া আপনার চেয়ে বড়ো সৌন্দর্যকে দুই হাত তুলিয়া অভিবাদন করিতেছে ; নিজের সমস্ত মহত্ত্ব দিয়া নিজের চেয়ে মহত্তরকেই নীরবে প্রচার করিতেছে । মানুষ এই সকল কারুপরিপূর্ণ নিস্তব্ধভাষার দ্বারা বলিয়াছে, দেখো, চাহিয়া দেখো, যিনি সুন্দর তীহাকে দেখো, যিনি মহান তঁহাকে দেখো । সে এ কথা বলিতে চাহে নাই যে, আমি কতবড়ো ভোগী সেইটে