পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ჟ8br রবীন্দ্র-রচনাবলী লোকালয়ের পথ দিয়া চলিতে চলিতে যখন দেখিতে পাও মানুষের অবকাশ নাই— মুদি দোকান চালাইতেছে, কামার লোহা পিটিতেছে, মজুর বোঝা লইয়া চলিয়াছে, বিষয়ী আপনার খাতার হিসাব তছে- সেইসঙ্গে আর-একটা জিনিস চোখে দেখিতে পাইতেছ না, কিন্তু একবার মনে মনে দেখে ; এই রাস্তার দুই ধারে ঘরে-ঘরে দোকানে-বাজারে অলিতে-গলিতে কত শাখায়-প্ৰশাখায় রসের ধারা কত পথ দিয়া কত মলিনতা কত সংকীর্ণতা কত দারিদ্র্যের উপরে কেবলই আপনাকে প্রসারিত করিয়া দিতেছে ; রামায়ণ-মহাভারত কথা-কাহিনী কীর্তন-পাচলি বিশ্বমানবের হৃদয়সুধাকে প্রত্যেক মানবের কাছে দিনরাত বঁটিয়া দিতেছে ; নিতান্ত তুচ্ছ লোকের ক্ষুদ্র কাজের পিছনে রাম লক্ষ্মণ আসিয়া দাড়াইতেছেন ; অন্ধকার বাসার মধ্যে পঞ্চবটীর করুণামিশ্রিত হাওয়া বহিতেছে ; মানুষের হৃদয়ের সৃষ্টি হৃদয়ের প্রকাশ মানুষের কর্মক্ষেত্রের কাঠিন্য ও দারিদ্র্যাকে তাহার সৌন্দর্য ও মঙ্গলের কঙ্কণ-পরা দুটি হাত দিয়া বেড়িয়া রহিয়াছে । সমস্ত সাহিতাকে সমস্ত মানুষের চারি দিকে একবার এমনি করিয়া দেখিতে হইবে । দেখিতে হইবে, মানুষ আপনার বাস্তব সত্তাকে ভাবের সত্তায় নিজের চতুর্দিকে আরো অনেক দূর পর্যন্ত বাড়াইয়া লইয়া গেছে । তাহার বর্ষার চারি দিকে কত গানের বর্ষা, কাব্যের বর্ষা, কত মেঘদূত, কত বিদ্যাপতি বিস্তীর্ণ হইয়া আছে ; তাহার ছোটাে ঘরটির সুখদুঃখকে সে কত চন্দ্ৰসূর্যবংশীয় রাজাদের সুখদুঃখের কাহিনীর মধ্যে বড়ো করিয়া তুলিয়াছে! তাহার ঘরের মেয়েটিকে ঘিরিয়া গিরিরাজকনার করুণা সর্বদা সঞ্চরণ করিতেছে ; কৈলাসের দরিদ্রদেবতার মহিমার মধ্যে সে আপনার দারিদ্রাদুঃখকে প্রসারিত করিয়া দিয়াছে ! এইরূপে অনবরত মানুষ আপনার চারি বাড়াইয়া চলিতেছে । যে মানুষ অবস্থার দ্বারা সংকীর্ণ সেই মানুষ নিজের ভাবসৃষ্টিদ্বারা নিজের এই-যে বিস্তার রচনা করিতেছে, সংসারের চাবি দিকে যাহা একটি দ্বিতীয় সংসার, তাহাই সাহিত । এই বিশ্বসাহিতো। আমি আপনাদের পথপ্রদর্শক হইব এমন কথা মনেও করিবেন না । নিজের নিজের সাধা-অনুসারে এ পথ আমাদের সকলকে কাটিয়া চলিতে হইবে । আমি কেবল এইটুকু বলিতে চাহিয়াছিলাম যে, পৃথিবী যেমন আমার খেত এবং তোমার খেত এবং তাহার খেত নহে, পৃথিবীকে তেমন করিয়া জানা অত্যন্ত গ্ৰাম্যভাবে জানা, তেমনি সাহিতা আমার রচনা, তোমার রচনা এবং তাহার রচনা নহে । আমরা সাধারণত সাহিত্যকে এমনি করিয়াই গ্রাম্যাভাবেই দেখিয়া থাকি | সেই গ্রামা সংকীর্ণত হইতে নিজেকে মুক্তি দিয়া বিশ্বসাহিত্যের মধ্যে বিশ্বমানবকে দেখিবার লক্ষ্য আমরা স্থির করিব, প্রত্যেক লেখকের রচনার মধ্যে একটি সমগ্রতাকে গ্ৰহণ করিব এবং সেই সমগ্রতার মধ্যে সমস্ত মানুষের প্রকাশচেষ্টার সম্বন্ধ দেখিব, এই সংকল্প স্থির করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে ! A S 3 S সৌন্দর্য ও आश्ठिा ‘সৌন্দর্যবোধ’ ও ‘বিশ্বসাহিত্য প্রবন্ধে আমার বক্তব্য বিষয়টি স্পষ্ট হয় নাই, এমন অপবাদ প্রচাব হওয়াতে যথাসাধ্য পুনরুক্তি বঁাচাইয়া মূলকথাটা পরিষ্কার করিয়া লইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলাম । যেমন জগতে যে ঘটনাটিকে কেবল এইমাত্র জানি যে তাহা ঘটিতেছে, কিন্তু কেন ঘটিতেছে, তাহার পূর্বাপর কী, জগতের অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ কোথায়, তাহা না জানিলে তাঁহাকে পুরাপুরি আমাদের জ্ঞান জানা হয় না- তেমনি জগতে যে সত্য কেবল আছে মাত্র বলিয়াই জানি, কিন্তু তাহাতে আমার কোনো আনন্দই নাই, তাহা আমার হৃদয়ের পক্ষে একেবারে নাই বললেই হয়। এই-যে এতবড়ো জগতে আমরা রহিয়াছি ইহার অনেকটাকেই আমাদের জানা-জগতের সম্পূর্ণ সামিল করিয়া আনিতে পারি নাই এবং ইহার অধিকাংশই আমাদের মনোহর জগতের মধ্যে ভুক্ত হইয়া আমাদের আপনি হইয়া উঠে নাই ।