পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ6l\ტ রবীন্দ্র-রচনাবলী বঙ্গকাননে বিবিধ কঠের বিচিত্র কলাগানের অধিনেতা হইয়া বর্তমানের উৎসাহে আনন্দধ্বনি উদ্ভূিত করিয়া তুলিবেন— এবং কোনোকালে যে অমানিশীথের একাধিপত্য ছিল এবং অদ্যকার আমরা যে প্রদোষের অন্ধকারে ক্লান্তি এবং শান্তি, আশা এবং নৈরাশ্যের দ্বিধার মধ্যে সকরুণ দুর্বল কণ্ঠের গীতগান সমাপ্ত করিয়া নিদ্রা গিয়াছিলাম। সে কথা কাহারও মনে থাকিবে না । Kafr y Odo বঙ্গভাষা ও সাহিত্য আমাদের সৌভাগাক্ৰমে দীনেশচন্দ্রবাবুর 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত : হইয়াছে। এই উপলক্ষে পুস্তকখানি দ্বিতীয়বার পাঠ করিয়া আমরা দ্বিতীয়বার আনন্দলাভ করিলাম । এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ যখন বাহির হইয়াছিল তখন দীনেশবাবু আমাদিগকে বিস্মিত করিয়া দিয়াছিলেন । প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য বলিয়া এতবড়ো একটা ব্যাপার যে আছে তাহা আমরা জানিতাম না ; তখন সেই অপরিচিতের সহিত পরিচয়স্থাপনেই ব্যস্ত ছিলাম । দ্বিতীয়বার পাঠে গ্রন্থের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিবার সময় ও সুযোগ পাইয়াছি। এবারে বাংলার প্রাচীন সাহিত্যকারদের স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগত পরিচয়ে বা তুলনামূলক সমালোচনায় আমাদের মন আকর্ষণ করে নাই ; আমরা দীনেশবাবুর গ্রন্থের মধ্যে বাংলাদেশের বিচিত্রশাখাপ্রশাখাসম্পন্ন ইতিহাস-বনস্পতির বৃহৎ আভাস দেখিতে পাইয়াছি। যে-সকল গ্ৰন্থকে বাংলার ইতিহাস বলে তাহাও পড়া গিয়াছে। তাহার মধ্যে বাদশাহদের সহিত নবাবদের, নবাবদের সহিত বিদেশী বণিকদের ও বণিকদের সহিত দেশী ষড়যন্ত্রকারীদের কী খেলা চলিতেছিল তাহার অনেক সত্যমিথ্যা বিবরণ পাওয়া যায় । সে-সকল বিবরণ যদি কোনো দৈব ঘটনায় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় তবে বাংলাদেশকে চিনিবার পক্ষে অল্পই ব্যাঘাত ঘটে। বাংলাদেশের সহিত নবাবদের কী সম্বন্ধ ছিল তাহার বিবরণ বাংলাসাহিত্যের ইতস্তত যেটুকু পাওয়া যায় তাহাই পর্যাপ্ত ; তাহার অতিরিক্ত যাহা পাঠ্যগ্রন্থে আলোচিত হয় তাহা ব্যক্তিগত কাহিনীমাত্র । কিন্তু দীনেশবাবুর এই গ্রন্থে হুসেন-শা পরাগল-খা, ছুটি-খা'র সহিত আমাদের যেটুকু পরিচয় হইয়াছে তাহাতে ইতিহাস আমাদের কাছে অনেকটা সজীব হইয়া উঠিয়াছে। মুসলমান ও হিন্দু যে কত কাছাকাছি ছিল, নানা উপদ্রব-উদ্ধৃঙ্খলতা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে যে হৃদ্যতার পথ ছিল, ইহা এমন একটি কথা যাহা যথার্থই জ্ঞাতব্য, যাহা প্রকৃতপক্ষেই ঐতিহাসিক । ইহা দেশের কথা, ইহা লোকবিশেষের সংবাদবিশেষ নহে! যেমন ভূস্তরপর্যায়ে ভূমিকম্প অগ্নি-উচ্ছােস জলপ্লাবন তুষারসংহতি কালে কালে ভূমিগঠনের ইতিহাস নানা অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে এবং বৈজ্ঞানিক সেই লিপি উদঘাটন করিয়া বিচিত্র সৃজনশক্তির রহস্যলীলা বিস্ময়ের সহিত পাঠ করেন, তেমনি যে-সকল প্ৰলয়,শক্তি ও সৃজনশক্তি অদৃশ্যভাবে সমাজকে পরিণতি দান করিয়া আসিয়াছে সাহিত্যের স্তরে স্তরে তাঁহাদের ইতিবৃত্ত আপনি মুদ্রিত হইয়া যায়। সেই নিগৃঢ় ইতিহাসটি উদঘাটন করিতে পারিলে প্রকৃতভাবে সজীবভাবে আমাদের দেশকে আমরা জানিতে পারি। রাজার দপ্তর ঘাটিয়া যে-সকল কীটজর্জর দলিল পাওয়া যায় তাহাতে অনেক সময়ে কেবলমাত্র কৌতুহল পরিতৃপ্ত ও অনেক সময়ে ভুল। ইতিহাসের সৃষ্টি হইতে পারে ; কারণ, তাহাকে তাহার যথাস্থান ও যথাসময় হইতে, তাহার চারিপাশ হইতে, বিচ্যুত আকারে যখন দেখি তখন কল্পনা ও প্রবৃত্তির বিশেষ ঝোকে তাহাকে অসত্যরূপে বড়ো বা অসত্যরূপে ছােটাে করিয়া দেখিতে পারি । বৌদ্ধযুগের পরবর্তী ভারতবৰ্ষই বর্তমান ভারতবর্ষ। সেই যুগের অন্তিম অবস্থায় যখন গৌড়ের রাজসিংহাসন ক্ষণে ক্ষণে হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজত্বের মধ্যে দোলায়মান হইতেছিল তখন প্রজাসাধারণের