পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য Šbrዓ রসের সৃজনটাই উদ্দেশ্য, অতএব সেজন্য ঐতিহাসিক উপকরণ যে পরিমাণে যতটুকু সাহায্য করে সে পরিমাণে ততটুকু লইতে কবি কুষ্ঠিত হন না। যতটুকু শেকসপীয়রের ‘অ্যান্টনি এবং ক্লিয়ােপট্রি' নাটকের যে মূল্যব্যাপারটি তাহা সংসারের প্রত্যহিক পরীক্ষিত ও পরিচিত সত্য। অনেক অখ্যাত অজ্ঞাত সুযোগ্য লোক কুহকিনী-নারীমায়ার জলে আপন ইহকাল-পরকাল বিসর্জন করিয়াছে। এইরূপ ছােটােখাটাে মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বের শোচনীয় ভগ্নাবশেষে সংসারের পথ পরিকীর্ণ। আমাদের সুপ্রত্যক্ষ নরনারীর বিষামৃতময় প্রণয়লীলাকে কবি একটি সুবিশাল ঐতিহাসিক রঙ্গভূমির মধ্যে স্থাপিত করিয়া তাহাকে বিরাট করিয়া তুলিয়াছেন। হৃদবিপ্লবের পশ্চাতে রাষ্ট্রবিপ্লবের মেঘাড়ম্বর, প্রেমদ্বন্দ্বের সঙ্গে একবন্ধনের দ্বারা বদ্ধ রোমের প্রচণ্ড আত্মবিচ্ছেদের সমরায়োজন। ক্লিয়োপাট্রার বিলাসকক্ষে বীণা বাজিতেছে, দূরে সমুদ্রতীর হইতে ভৈরবের সংহারশূঙ্গ ধ্বনি তাহার সঙ্গে এক সুরে মন্দ্রিত হইয়া উঠিতেছে। আদি এবং করুণ রসের সহিত কবি ঐতিহাসিক রস মিশ্ৰিত করিতেই তাহা এমন-একটি চিত্তবিম্ফারক দূরত্ব ও বৃহত্ত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। : ইতিহাসবেত্তা মমসেন পণ্ডিত যদি শেকসপীিয়রের এই নাটকের উপরে প্রমাণের তীক্ষ আলোক নিক্ষেপ করেন তবে সম্ভবত ইহাতে অনেক কালবিরোধ-দোষ (anachronism), অনেক ঐতিহাসিক ভ্রম বাহির হইতে পারে। কিন্তু শেক্সপীয়র পাঠকের মনে যে মােহ উৎপাদন করিয়াছেন, ভ্রান্ত বিকৃত ইতিহাসের দ্বারাও যে-একটি ঐতিহাসিক রসের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা ইতিহাসের নূতন তথ্য-আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হইবে না । সেইজন্য আমরা ইতিপূর্বে কোনো-একটি সমালোচনায় লিখিয়ছিলাম, ‘ইতিহাসের সংস্রবে উপন্যাসে একটা বিশেষ রস সঞ্চার করে, ইতিহাসের সেই রাসটুকুর প্রতি ঔপন্যাসিকের লোভ, তাহার সত্যের প্রতি র্তাহার কোনাে খাতির নাই। কেহ যদি উপন্যাসে কেবল ইতিহাসের সেই বিশেষ গন্ধটুকু এবং স্বাদটুকুতে সন্তুষ্ট না হইয়া তাহা হইতে অখণ্ড ইতিহাস-উদ্ধারে প্রবৃত্ত হন তবে তিনি ব্যঞ্জনের মধ্যে আস্ত জিরে-ধন-হলুদ-সর্ষে সন্ধান করেন ; মসলা আস্ত রাখিয়া যিনি ব্যঞ্জনে স্বাদ দিতে পারেন তিনি দিন, যিনি বাটিয়া ঘাটিয়া একাকার করিয়া থাকেন তাহার সঙ্গেও আমার কোনো বিবাদ নাই ; কারণ, স্বাদই এ স্থলে, লক্ষ্য, মসলা উপলক্ষমাত্র ।” অর্থাৎ লেখক ইতিহাসকে অখণ্ড রাখিয়াই চলুন আর খণ্ড করিয়াই রাখুন, সেই ঐতিহাসিক রসের অবতারণায় সফল হইলেই হইল । তাই বলিয়া কি রামচন্দ্ৰকে পামর এবং রাবণকে সাধুরূপে চিত্রিত করিলে অপরাধ নাই ? অপরাধ আছে | কিন্তু তাহা ইতিহাসের বিরুদ্ধে অপরাধ নহে, কাব্যেরই বিরুদ্ধে অপরাধ। সর্বজনবিদিত সত্যকে একেবারে উলটা করিয়া দাড় করাইলে রাসভঙ্গ হয়, হঠাৎ পাঠকদের যেন একেবারে মাথায় বাড়ি পড়ে। সেই একটা দমকাতেই কাব্য একেবারে কত হইয়া ডুবিয়া যায়। এমনকি, যদি কোনো ঐতিহাসিক মিথ্যাও সর্বসাধারণের বিশ্বাস আকর্ষণ করিয়া বরাবর চলিয়া আসে, ইতিহাস এবং সত্যের পক্ষ লইয়া কাব্য তাহার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করিলে দোষের হইতে পারে। মনে করো আজ যদি নিঃসংশয়ে প্রমাণ হয় যে, সুরাসক্ত অনাচারী যদুবংশ গ্ৰীকজাতীয় এবং শ্ৰীকৃষ্ণ স্বাধীন বনবিহারী বংশীবাদক গ্ৰীসীয় রাখাল, যদি জানা যায় যে তাহার বর্ণ জ্যেষ্ঠ বলদেকের বর্ণের ন্যায় শুভ্র ছিল, যদি স্থির হয় নির্বাসিত অর্জন এশিয়া-মাইনরের কোনাে গ্ৰীক রাজ্য হইতে য়ুনানী রাজকন্যা সুভদ্রকে হরণ করিয়া আনিয়াছিলেন এবং দ্বারকা সমুদ্রতীরবর্তী কোনাে গ্ৰীক উপদ্বীপ, যদি প্রমাণ হয় নির্বাসনকালে পাণ্ডবগণ বিশেষ রণবিজ্ঞানবেত্তা প্রতিভাশালী গ্ৰীসীয় বীর কৃষ্ণের সহায়তা লাভ করিয়া স্বরাজ্য উদ্ধার করিয়াছিলেন, তাহার অপূর্ব বিজাতীয় রাজনীতি যুদ্ধনৈপুণ্য এবং কর্মপ্রধান ধর্মতত্ত্ব বিস্মিত ভারতবর্ষে তঁহাকে অবতাররূপে দাড় করাইয়াছে- তথাপি বেদব্যাসের মহাভারত বিলুপ্ত হইবে না, এবং কোনাে নবীন কবি সাহসপূর্বক কালাকে গােরা করিতে পারবেন না। ’ আমাদের এইগুলি সাধারণ কথা। নবীনবাবুও বঙ্কিমবাবুর্তাহাদের কাব্যে এবং উপন্যাসে প্রচলিত