পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ኃbrbr রবীন্দ্র-রচনাবলী ইতিহাসের বিরুদ্ধে এতদূর গিয়াছেন কি না যাহাতে কাব্যরস নষ্ট হইয়াছে তাহা তঁহাদের গ্রন্থের বিশেষ সমালোচনা-স্থলে বলা যাইতে পারে। এক্ষণে কর্তব্য কী ? ইতিহাস পড়িব না আইভানহাে পড়িব ? ইহার উত্তর অতি সহজ । দুইই পড়ে। সত্যের জন্য ইতিহাস পড়ো, আনন্দের জন্য আইভানহাে পড়ে। পাছে ভুল শিখি এই সতর্কতায় কাব্যরস হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিলে স্বভাবটা শুকাইয়া শীর্ণ হইয়া যায়। কাব্যে যদি ভুল শিখি ইতিহাসে তাহা সংশোধন করিয়া লইব । কিন্তু যে ব্যক্তি ইতিহাস পড়িবার সুযোগ পাইবে না, কাব্যই পড়িবে, সে হতভাগ্য। কিন্তু যে ব্যক্তি কাব্য পড়িবার অবসর পাইবে না, ইতিহাস পড়িবে, সম্ভবত তাহার ভাগ্য আরো মন্দ | আশ্বিন ১৩০৫ কবিজীবনী কবি টেনিসনের পুত্র তাহার পরলোকগত পিতার চিঠিপত্র ও জীবনী বৃহৎ দুইখণ্ড পুস্তকে প্রকাশ করি शigछन् | প্রাচীন কবিদের জীবনের বিস্তৃত বিবরণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তখন জীবনীর শখ লোকের ছিল না ; তাহা ছাড়া তখন বড়ো-ছোটাে সকল লোকেই এখনকার চেয়ে অপ্রকাশ্যে বাস করিত | চিঠিপত্র, খবরের কাগজ, সভাসমিতি, সাহিত্যের বাদবিরোধ এমন প্রবল ছিল না। সুতরাং প্রতিভাশালী ব্যক্তির জীবনব্যাপারকে নানা দিক হইতে প্রতিফলিত দেখিবার সুযোগ তখন ঘটিত না । অনেক ভ্ৰমণকারী বড়ো বড়ো নদীর উৎস খুঁজতে দুৰ্গম স্থানে গিয়াছে। বড়ো কাব্যনদীর উৎস খুঁজতেও কৌতুহল হয়। আধুনিক কবির জীবনচরিতে এই কৌতুহল নিবৃত্ত হইতে পারে এমন আশা মনে জন্মে। মনে হয় আধুনিক সমাজে কবির আর লুকাইবার স্থান নাই ; কাব্যস্রোতের উৎপত্তি যে শিখরে সে পর্যন্ত রেলগাড়ি চলিতেছে। সেই আশা করিয়াই পরমাগ্রহে বৃহৎ দুইখণ্ড বই শেষ করা গেল। কিন্তু কবি কোথায়, কাব্যস্রোত কোন গুহা হইতে প্রবাহিত হইতেছে, তাহা তো খুজিয়া পাওয়া গেল না । ইহা টেনিসনের জীবনচরিত হইতে পারে, কিন্তু কবির জীবনচরিত নহে। আমৱা বুঝিতে পারিলাম না, কবি কবে মানবহৃদয়সমুদ্রের মধ্যে জাল ফেলিয়া এত জ্ঞান ও ভাব আহরণ করিলেন এবং কোথায় বসিয়া বিশ্বসংগীতের সুরগুলি র্তাহার বঁাশিতে অভ্যাস করিয়া লইলেন । কাব্য নহে ; যাহারা কর্মবীর তঁাহারা নিজের জীবনকে নিজে সৃজন করেন । কবি যেমন ভাষার বাধার মধ্য হইতে ছন্দকে গাথিয়া তোলেন, যেমন সামান্য ভাবকে অসামান্য সুর এবং ছোটাে কথাকে বড়ো অর্থ দিয়া থাকেন, তেমনি কর্মবীরগণ সংসারের কঠিন বাধার মধ্যে নিজের জীবনের ছন্দ নির্মাণ করেন এবং চারি দিকের ক্ষুদ্রতাকে অপূর্ব ক্ষমতাবলে বড়ো করিয়া লন । তাহার হাতের কাছে যে-কিছু সামান্য মাল-মসলা পান তাহা দিয়াই নিজের জীবনকে মহৎ করেন এবং তাহাদিগকেও বৃহৎ করিয়া না | কিন্তু কবির জীবন মানুষের কী কাজে লাগিবে ? তাহাতে স্থায়ী পদাৰ্থ কী আছে ? কবির নামের সঙ্গে বাধিয়া তাহাকে উচ্চে টােঙাইয়া রাখিলে, ক্ষুদ্রকে মহতের সিংহাসনে বসাইয়া লজ্জিত করা হয় । জীবনচরিত মহাপুরুষের এবং কাব্য মহাকবির। কোনো ক্ষণজন্মা ব্যক্তি কাব্যে এবং জীবনের কর্মে উভয়তই নিজের প্রতিভা বিকাশ করিতে পারে ; কাব্য ও কর্ম উভয়ই তাহার এক প্রতিভার ফল । তাহদের কাব্যকে তঁহাদের জীবনের সহিত একত্র