পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য ዒOw© V একটিমাত্র গাছকে প্রকৃতি বলা যায় না। তেমনি কোনাে একটিমাত্র বর্ণনাকে যদি সাহিত্য বলে ধর তাহলে আমার কথাটা বােঝানাে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। বর্ণনা সাহিত্যের অন্তর্গত সন্দেহ নেই, কিন্তু তার দ্বারা সাহিত্যকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। একটিমাত্র সূর্যন্তবর্ণনার মধ্যে লেখকের জীবনাশে এত অল্প থাকতে পারে যে, হয়তো সেটুকু বোধগম্য হওয়া দুরূহ। কিন্তু উপরি-উপরি অনেকগুলি বৰ্ণনা দেখলে লেখকের মর্মগত ভাবটুকু আমরা ধরতে পারতুম। আমরা বুঝতে পারতুম লেখক বাহ্যপ্রকৃতির মধ্যে একটা আত্মার সংস্রব দেখেন কি না ; প্রকৃতিকে তিনি মানবসংসারের চারিপার্শ্ববতী দেয়ালের ছবির মতো দেখেন না মানবসংসারকে এই প্ৰকাণ্ড রহস্যময়ী প্রকৃতির একান্তবতীস্বরূপ দেখেন- কিংবা মানবের সহিত প্রকৃতি মিলিত হয়ে, প্রাত্যহিক সহস্র নিকটসম্পর্কে বদ্ধ হয়ে, তার সম্মুখে একটি বিশ্বব্যাপী গার্হস্থ্য দৃশ্য উপস্থিত করে। -- সেই তত্ত্বটুকুকে জানানোই যে সাহিত্যের উদ্দেশ্য তা নয়, কিন্তু সে অলক্ষিত ভাবে আমাদের মনের উপর কার্য করে- কখনো বেশি সুখ দেয়, কখনো অল্প সুখ দেয় ; কখনো মনের মধ্যে একটা বৃহৎবৈরাগ্যের আভাস আনে, কখনো-বা অনুরাগের প্রগাঢ় আনন্দ উদ্রেক করে। সন্ধ্যার বর্ণনায় কেবল যে সূর্যান্তের আভা পড়ে তা নয়, তার সঙ্গে লেখকের মানবহৃদয়ের আভা কখনো মান শ্ৰান্তির ভাবে কখনাে গভীর শান্তির ভাবে স্পষ্টত অথবা অস্পষ্টত মিশ্রিত থাকে এবং সেই আমাদের হৃদয়কে অনুরূপ ভাবে রাজিত করে তোলে। নতুবা, তুমি যেরকম বর্ণনার কথা বলেছ সেরকম বর্ণনা ভাষায় অসম্ভব। ভাষা কখনোই রেখাবর্ণময় চিত্রের মতো অমিশ্র অবিকল প্রতিরূপ আমাদের সম্মুখে আনয়ন zqSV5 9(3 R | বলা বাহুল্য, যেমন-তেমন লেখকের যেমন-তেমন বিশেষত্বই যে আমরা প্রার্থনীয় জ্ঞান করি তা নয়। মনে করো, পথ দিয়ে মন্ত একটা উৎসবের যাত্রা চলেছে। আমার এক বন্ধুর বারান্দা থেকে তার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ দেখতে পাই, আর-এক বন্ধুর বারান্দা থেকে বৃহৎ অংশ এবং প্রধান অংশ দেখতে পাই-আর-এক বন্ধু আছেন তার দোতলায় উঠে যেদিক থেকেই দেখতে চেষ্টা করি কেবল র্তার নিজের বারান্দার্টুকুই দেখি। প্রত্যেক লোক আপনি আপনি বিশেষত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে জগতের এক-একটা দৃশ্য দেখছে- কেউ বা বৃহৎ ভাবে দেখছে, কেউ-বা কেবল আপনাকেই দেখছে। যে আপনাকে ছাড়া আর-কিছুই দেখাতে পারে না সাহিত্যের পক্ষে সে বাতায়নহীন অন্ধকার কারাগার মাত্র । কিন্তু এ উপমায় আমার কথাটা পুরো বলা হল না এবং ঠিকটি বলা হল না। আমার প্রধান কথাটা এই- সাহিত্যের জগৎমানেই হচ্ছে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশ্ৰিত জগৎ । সূর্যন্তকে তিনরকম ভাবে দেখা যাক। বিজ্ঞানের সূর্যস্ত, চিত্রের সূর্যন্ত এবং সাহিত্যের সূর্যস্ত। বিজ্ঞানের সূর্যস্ত হচ্ছে নিছক সূর্যন্ত ঘটনাটি ; চিত্রের সূর্যস্ত হচ্ছে কেবল সূর্যের অন্তর্ধনমাত্র নয়, জল স্থল আকাশ মেঘের সঙ্গে মিশ্রিত করে সূর্যন্ত দেখা ; সাহিত্যের সূর্যন্ত হচ্ছে সেই জল স্থল আকাশ মেঘের মধ্যবর্তী সূর্যন্তকে : মানুষের জীবনের উপর প্রতিফলিত করে দেখা- কেবলমাত্র সূর্যান্তের ফোটােগ্রাফ তোলা নয়, আমাদের মর্মের সঙ্গে তাকে মিশ্রিত করে প্রকাশ। যেমন, সমুদ্রের জলের উপর সন্ধ্যাকাশের প্রতিবিম্ব পড়ে একটা অপরাপ সৌন্দর্যের উদ্ভব হয়, আকাশের উজ্জ্বল ছায়া জলের স্বচ্ছ তরলতার যোগে একটা নূতন ধর্মপ্রাপ্ত হয়, তেমনি জগতের প্রতিবিম্ব মানবের জীবনের মধ্যে পতিত হয়ে সেখান থেকে প্রাণ ও হৃদয়বৃত্তি লাভ করে। আমরা প্রকৃতিকে আমাদের নিজের সুখদুঃখ আশা-আকাঙক্ষা দান করে একটা নূতন কাণ্ড করে তুলি ; অস্ত্ৰভেদী জগৎসৌন্দর্যের মধ্যে একটা অমর প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করি— এবং তখনই সে সাহিত্যের উপযোগিতা প্রাপ্ত হয়। ] প্রাকৃতিক দৃশ্যে দেখা যায়, সূর্যোদয় সূর্যস্ত সর্বত্র সমান বৈচিত্র্য ও বিকাশ লাভ করে না। বাঁশতলার পানাপুকুর সকলপ্রকার আলােকে কেবল নিজেকেই প্রকাশ করে, তাও পরিষ্কাররূপে নয়,