পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Օ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী নিতান্ত জটিল আবিল অপরিচ্ছন্নভাবে ; তার এমন স্বচ্ছতা এমন উদারতা নেই যে, সমস্ত প্ৰভা৩ে৭ আকাশকে সে আপনার মধ্যে নূতন ও নির্মল করে দেখাতে পারে । সুইজারল্যাণ্ডের শৈলসরোবর সম্বন্ধে আমার চেয়ে তোমার অভিজ্ঞতা বেশি আছে, অতএব তুমিই বলতে পার সেখানকার উদযান্ত কিরকম অনির্বাচনীয় শোভাময় মানুষের মধ্যেও সেইরকম আছে ? বড়ো বড়ো লেখকেরা নিজের উদারতা-অনুসারে সকল জিনিসকে এমন করে প্রতিবিম্বিত করতে পারে যে, তার কতখানি নিজের কতখানি বাহিবের কতখানি বিম্বের কতখানি প্রতিবিম্বের নির্দিষ্টরূপে প্ৰভেদ করে দেখানো কঠিন হয়। কিন্তু সংকীর্ণ কৃনে কল্পনা যাকেই প্রকাশ করতে চেষ্টা করুক-না কেন, নিজের বিশেষ আকৃতিটাকেই সর্বাপেক্ষা প্ৰধান দিয়ে থাকে অতএব লেখকের জীবনের মূলতত্ত্বটি যতই ব্যাপক হবে, মানবসমাজ এবং প্রকৃতির প্রকাণ্ড রহসাকে যতই সে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ সিদ্ধান্তে টুকরো টুকরো করে না ভেঙে ফেলবে, আপনার জীবনের দশ দিক উন্মুক্ত করে নিখিলের সমগ্রতাকে আপনার অন্তরের মধ্যে আকর্ষণ করে নিয়ে একটি বৃহৎ চেতনার সৃষ্টি করবে, ততই তার সাহিত্যের প্রকাণ্ড পরিধির মধ্যে তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দুটি অদৃশ্য হয়ে যাবে ! সেইজনো মহৎ রচনার মধ্যে একটি বিশেষ মত একটি ক্ষুদ্র ঐক্য খুঁজে বার করা দায় ; আমরা ক্ষুদ্র সমালোচকেরা নিজের ঘর-গড়া মত দিয়ে যদি তাকে ঘিরতে চেষ্টা করি তা হলে পদে পদে তার মধ্যে স্বতোবিরোধ বেধে যায় ; কিন্তু একটা অত্যন্ত দুৰ্গম কেন্দ্ৰস্থানে তার একটা বৃহৎ মীমাংসা বিরাজ করছে, সেটি হচ্ছে লেখকের মর্মস্থান— অধিকাংশ স্থলেই লেখকের নিজের পক্ষেও সেটি অনাবিষ্কৃত রাজা । শেকসপীয়রের লেখার ভিতর থেকে তার একটা বিশেষত্ব খুঁজে বার করা কঠিন এইজনে যে, তার সেটা অত্যন্ত বৃহৎ বিশেষত্ব । তিনি জীবনের যে মূলতত্ত্বটি আপনার অন্তরের মধ্যে সৃজন করে তুলেছেন তাকে দুটি-চারটি সুসংলগ্ন মতপাশ দিয়ে বদ্ধ করা যায় না ! এইজনে ভ্রম হয় তাঁর রচনার মধ্যে যেন একটি রচয়িত-ঐক্য নেই । কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেইটে যে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা চাই আমি তা বলি নে ; কিন্তু সে যে যেমন করেই দেখি, আমরা মানুষকেই চাই, সাক্ষাৎভাবে বা পরোক্ষভাবে ; মানুষের সম্বন্ধে কাটাছেড়া তত্ত্ব চাই নে, মূল মানুষটিকেই চাই । তার হাসি চাই, তার কাল্লা চাই ; তার অনুরাগ বিরাগ কিন্তু, এই হাসিকান্না অনুরাগ-বিরাগ কোথা থেকে উঠছে ? ফলস্টাফ ও ডগবেরি থেকে আরম্ভ করে লিয়র ও হ্যামলেট পর্যন্ত শেকসপীয়র যে মানবলোক সৃষ্টি করেছেন সেখানে মনুষ্যত্বে চিরস্থায়ী হাসি-অশ্রদ্ধর গভীর উৎসগুলি কারও অগোচর নেই ; একটা সোসাইটি নভেলের প্রাতাহিক কথাবার্তা এবং খুচরো হাসিকান্নার চেয়ে আমরা শেকসপীিয়রের মধ্যে বেশি সত্য অনুভব করি। যদিচ সোসাইটি নভেলে যা বর্ণিত হয়েছে তা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অবিকল অনুরূপ চিত্র । কিন্তু আমরা জানি আজকের সোসাইটি নভেল কাল মিথ্যা হয়ে যাবে, শেকসপীয়রা কখনো মিথ্যা হবে না। অতএব । একটা সোসাইটি নভেল যতই চিত্ৰবিচিত্র করে রচিত হোক, তার ভাষা এবং রচনাকীেশাল যতই সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হােক, শেকসপীয়রের একটা নিকৃষ্ট নাটকের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। সোসাইটি নভেলে । বর্ণিত প্ৰত্যহিক সংসারের যথাযথ বর্ণনার অপেক্ষা শেকসপীয়রে বর্ণিত প্রতিদিনদুর্লভ প্রবল । হৃদয়াবেগের বর্ণনাকে আমরা কেন বেশি সত্য মনে করি সেইটে স্থির হলে সাহিত্যের সত্য কাকে বলা । যায় পরিষ্কার বোঝা যাবে } শেকসপীয়রে আমরা চিরকালের মানুষ এবং আসল মানুষটিকে পাই, কেবল মুখের মানুষটি নয় । , মানুষকে একেবারে তার শেষ পর্যন্ত আলোড়িত করে শেকসপীিয়র তার সমস্ত মনুষ্যত্বকে অবারিত ' করে দিয়েছেন । তার অশ্রুজ্জল চোখের প্রান্তে ঈষৎ বিগলিত হয়ে রুমালের প্রান্তে শুষ্ক হচ্ছে না, তার - হাসি ওষ্ঠাধরকে ঈষৎ উদ্ভিন্ন করে কেবল মুক্ত দস্তুগুলিকে মাত্র বিকাশ করছে না- কিন্তু বিদীণ ।