পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

aのbr রবীন্দ্র-রচনাবলী সাহিত্য সেই অতিদুৰ্গম অন্তঃপুরের কাহিনী । সেই ঐক্যকে আমি মোটামুটি জীবনের মূলতত্ত্ব নাম দিয়েছি । কারণ, সেটা যদিও লেখক এবং সাহিত্যের দিক থেকে তত্ত্ব নয়, কিন্তু সমালোচকের দিক থেকে তত্ত্ব। যেমন জগতের কার্যপরম্পরা কতকগুলি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, কিন্তু বৈজ্ঞানিক যখনই তার নিত্যতা দেখতে পান। তখনই তাকে ‘নিয়ম’ নাম দেন । আমি যে মিলনের কথা বললুম সেটা যত মিলিত ভাবে থাকে মনুষ্যত্ব ততই অবিচ্ছিন্ন সুতরাং আত্মসম্বন্ধে অচেতন থাকে । সেগুলোর মধ্যে যখন বিরোধ উপস্থিত হয় তখনই তাদের পরস্পরের সংঘাতে পরস্পর সম্বন্ধে একটা স্বতন্ত্র চেতনা জন্মায়। তখনই বুঝতে পারি, আমার সংস্কার এক জিনিস, বাস্তবিক সত্য আর-এক জিনিস, আবার আমার কল্পনার ক্ষেত্র স্বতন্ত্র | তখন আমাদের একান্নবর্তী মানসপরিবারকে পৃথক করে দিই এবং প্রত্যেকের স্ব স্ব প্রাধানা উপলব্ধি করি । কিন্তু শিশুকালে যেখানে এরা একত্র জন্মগ্রহণ করে মানুষ হয়েছিল পৃথক হয়েও সেইখানে এদের একটা মিলনের ক্ষেত্ৰ আছে। সাহিত্য সেই আনন্দসংগমের ভাষা | পূর্বের মতো সাহিত্যের সে আত্মবিস্মৃতি নেই ; কেননা এখনকার এ মিলন চিরমিলন নয়, এ বিচ্ছেদের মিলন । এখন আমরা স্বতন্ত্রভাবে বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস আলোচনা করি ; তার পরে এক সময়ে সাহিত্যের মধ্যে, মানসিক ঐক্যের মধ্যে, আনন্দ লাভ করি ; পূর্বে সাহিত্য অবশ্যম্ভাবী ছিল, এখন সাহিত্য অত্যাবশ্যক হয়েছে। মনুষ্যত্ব বিভক্ত হয়ে গেছে, এইজন্যে সাহিত্যের মধ্যে সে আপনার পরিপূর্ণতার আস্বাদলাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। এখনই সাহিত্যের বড়ো বেশি আবশ্যক এবং তার আদরও বেশি। এখন এই পূৰ্ণমনুষ্যত্বের সংস্পর্শ সচরাচর কোথাও পাওয়া যায় না । সমাজে আমরা আপনাকে খণ্ডভাবে প্রকাশ করি। বাধাৰ্বিাধি নিয়মের মধ্যে যতটা দূর যাওয়া যায় তার বেশি অগ্রসর হতে পারি নে ! চুটকি হাসি এবং খুচরো কথার মধ্যে আপনাকে আবৃত করে রাখি | মানুষ সামনে উপস্থিত হবামােত্রই আমরা এমনি সহজে স্বভাবতই আত্মসমবৃত হয়ে বসি যে, একটা গুরুতর ঘটনার দ্বারা অকস্মাৎ অভিভূত না হলে কিংবা একটা অতিপ্রবল আবেগের দ্বারা সর্ববিস্মৃত না হলে আমরা নিজের প্রকৃত আভাস নিজে পাই নে। শেকসপীয়রের সময়েও এরকম সব আকস্মিক ঘটনা এবং প্রবল আবেগ সচরাচর উদ্ভব হতে পারত এবং বিদ্যুৎ-আলোকে মানুষের সমগ্র আগাগোড়া এক পলকে দৃষ্টিগোচর হত ; এখন সুসভ্য সুসংযত সমাজে আকস্মিক ঘটনা ক্রমশই কমে আসছে এবং প্রবল আবেগ সহস্ৰ বাধে আটকা পড়ে পোষ-মানা ভালুকের মতো নিজের নখদন্ত গোপন করে সমাজের মনোরঞ্জন করবার জন্যে কেবল নৃত্য করে- যেন সে সমাজের নট, যেন তার একটা প্ৰচণ্ড ক্ষুধা এবং রুদ্ধ আক্রোশ। ঐ বহুর্যোমশ আচ্ছাদনের নীচে নিশিদিন জ্বলছে না । সাহিত্যের মধ্যে শেকসপীিয়রের নাটকে, জর্জ এলিয়টের নভেলে, সুকবিদের কাব্যে সেই প্রচ্ছন্ন মনুষ্যত্ব মুক্তিলাভ করে দেখা দেয় । তারই সংঘাতে আমাদের আগাগোড়া জেগে ওঠে ; আমরা আমাদের প্রতিহত হাড়গোড়-ভাঙা ছাইচাপা অঙ্গহীন জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করি । এইরূপ সুবৃহৎ অনবরণের মধ্যে অশ্লীলতা নেই। এইজন্যে শেকসপীিয়র অশ্লীল নয়, রামায়ণ মহাভারত অশ্লীল নয় । কিন্তু ভারতচন্দ্ৰ অশ্লীল, জোলা অশ্লীল ; কেননা তা কেবল আংশিক অনাবরণ । আর-একটু খোলসা করে বলা আবশ্যক । সাহিত্যে আমরা সমগ্ৰ মানুষকে প্রত্যাশা করি । কিন্তু সব সময়ে সবটাকে পাওয়া যায় না, সমস্তটার একটা প্রতিনিধি পাওয়া যায় । কিন্তু প্ৰতিনিধি কাকে করা যাবে ? যাকে সমস্ত মানুষ বলে মানতে আমাদের আপত্তি নেই। ভালোবাসা স্নেহ দয়া ঘূণা ক্ৰোধ হিংসা এরা আমাদের মানসিক বৃত্তি ; এরা যদি অবস্থানুসারে মানবপ্রকৃতির উপর একাধিপত্য লাভ করে তাতে আমাদের অবজ্ঞা অথবা ঘূণার উদ্রেক করে না । কেননা এদের সকলেরই ললাটে রাজচিহ্ন আছে ; এদের মুখে একটা দীপ্তি প্ৰকাশ পায় । মানুষের ভালো এবং মন্দ সহস্র কাজে এরা আপনার চিহ্নাঙ্কিত রাজমোহর মেরে দিয়েছে। মানব-ইতিহাসের প্রত্যেক পৃষ্ঠায় এদের সহস্ৰটা করে সই আছে। অথচ ঔদরিকতাকে যদি সাহিত্যের