পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ASV রবীন্দ্র-রচনাবলী আয়োজন কে করিয়াছিল ? 弥 একবার ভাবিয়া দেখুন, বাঙালিকে আমরা যে বাঙালি বলিয়া অনুভব করিতেছি তাহা মানচিত্রে কোনো কৃত্রিম রেখার জন্য নহে। বাঙালির ঐক্যের মূলসূত্রটি কী ? আমরা এক ভাষায় কথা কই। আমরা দেশের এক প্রান্তে যে বেদনা অনুভব করি ভাষার দ্বারা দেশের অপর সীমান্তে তাহা সঞ্চার উদ্যত করিয়াও ইহা পারেন না। শতবৎসর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষ যে গান গাহিয়া গিয়াছেন শতবৎসর পরেও সেই গান বাঙালির কণ্ঠ হইতে উৎপাটিত করিতে পারে এত বড়ো তরবারি কোনাে রাজাস্ত্রশালায় আজও শানিত হয় নাই। একি সামান্য শক্তি আমাদের প্রত্যেক বাঙালির হাতে আছে! এ শক্তি ভিক্ষালব্ধ নহে। ভূমিষ্ঠ হইবার পরীক্ষণ হইতেই জননীর সুধাকণ্ঠ হইতে স্নেহবিগলিত এই শক্তি আমরা আনন্দের সহিত সমস্ত মন প্ৰাণ দিয়া আকর্ষণ করিয়া লইয়াছি এবং এই চিরন্তন শক্তিযোগে সমস্ত দূরত্ব লঙ্ঘন করিয়া, অপরিচয়ের সমস্ত বাধা ভেদ করিয়া, আজ এই সভাতলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের, উপস্থিত ও অনাগতের, সমস্ত বাঙালিকে আপনি উদবোেল হৃদয়ের সম্ভাষণ জানাইবার অধিকারী হইয়াছি । বাঙালির সঙ্গে বাঙালিকে গাথিবীর জন্য কত কাল ধরিয়া বঙ্গসাহিত্য হৃদয়তন্তুনির্মিত নানা রঙের একটা বিপুল মিলনজাল রচনা করিয়া আসিয়াছে। আজ তাহা আমাদের এত বেশি অঙ্গীভূত হইয়া গেছে যে, তাহা আমাদের শিরা পেশী প্রভৃতির মতো আমাদের চােখেই পড়িতে চায় না। এ দিকে রাজকীয় মন্ত্রণাসভায় দুই-এক জন দেশীয় মন্ত্রী-নিয়োগ বা পৌরসভায় দুই-চারি জন দেশীয় প্রতিনিধি -নির্বাচনের শূন্যগর্ভ বিড়ম্বনাকেই আমরা পরম সৌভাগ্য বলিয়া গণ্য করি। ঔষধ যতই কটু হয় তাহাকে ততই হিতকর বলিয়া ভ্ৰম হয় ; যে চেষ্টায় যত বেশি ব্যর্থকষ্ট তাহার ফলটুকুকে ততই অধিক বলিয়া আমরা মনে করি । কারণ, ভাঙা পথে তৈলহীন গোরুর গাড়ির চাকার মতো পণ্ডশ্রমই সব চেয়ে বেশি শব্দ করিতে থাকে- তাহার অস্তিত্ব এক মুহূর্ত ভুলিয়া থাকা কঠিন। কিন্তু কাজের সময় হঠাৎ দেখিতে পাই যাহা সত্য, যাহা কষ্টকল্পনা নহে, তাহার শক্তি অধিক, অথচ তাহা নিতান্ত সহজ। আমরা বিদেশী ভাষায় পরের দরবারে এত কাল যে ভিক্ষা কুড়াইলাম তাহাতে লাভের অপেক্ষা লাঞ্ছনার বোঝাই বেশি জমিল, আর দেশী ভাষায় স্বদেশীর হৃদয়-দরবারে যেমনি হাত পাতিলাম অমনি মুহুর্তের মধ্যেই মাতা যে আমাদের মুঠ ভরিয়া দিলেন। সেইজন্য আমি বিবেচনা করি আদ্যকার বাংলাভাষার দল যদি গদিটা দখল করিয়া বসে। তবে আর-সকলকে সেটুকু স্বীকার করিয়া যাইতে হইবে ; মনে রাখিতে হইবে এই মিলনোৎসবের “বন্দেমাতরং মহামন্ত্রটি বঙ্গসাহিত্যেরই Wr r 唤 এ কথা বিশেষরূপে মনে রাখিবেন যে, সাহিত্যই মানুষের যথার্থ মিলনের সেতু। কেন যে, তাহার কারণ এখানে বিবৃত করিয়া বলা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। আমাদের দেশে বলিয়াছেন : বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম। রসাত্মক বাক্যই কাব্য। বস্তুত কাব্যের সংজ্ঞা আর-কিছুই হইতে পারে না। রস জিনিসটা কী ? না যাহা হৃদয়ের কাছে কোনো-না-কোনো ভাবে প্রকাশ পায় তাহাঁই রস, শুদ্ধ জ্ঞানের কাছে যাহা প্ৰকাশ পায় তাহা রস নহে। কিন্তু সকল রসই কি সাহিত্যের বিষয় ? তাহা তো দেখিতে পাই না। ভোজন ব্যাপারে যে সুখসঞ্চার হয় তাহার মতো ব্যাপক রস মানবসমাজে আর নাই, শিশু হইতে বৃদ্ধ পর্যন্ত সর্বত্রই ইহার অধিকার। তবু তো রসনাতৃপ্তির আনন্দ সাহিত্যে কেবলমাত্র বিদূষককে আশ্রয় করিয়া নিজেকে হাস্যকর করিয়াছে। গীতিকাব্যের ছন্দে তাহার রসলীলা প্রকাশ পায় নাই, মহাকাব্যের মহাসভা হইতে সে তিরস্কৃত । অথচ গোপনে অনুসন্ধান করিলে জানা যাইবে যে, কবিজাতি স্বভাবতই ভোজনে অপটু বা মিষ্টান্নে অরসিক- শত্রুপক্ষেও এমন অপবাদ দেয় না । w ইহার একটা কারণ আছে। ভোজনের তৃপ্তিটুকু উদরপূরণের প্রয়োজনে প্রায়ই নিঃশেষ হইয়া যায়। ] তাহা আর উদ্যুবৃত্ত থাকে না। যে রস উদ্যুবৃত্ত থাকে না সে আপনাকে প্রকাশ করিবার জন্য ব্যাকুল হয়