পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য .ፃ »ዔ না। যেটুকু বৃষ্টি মাটির মধ্যেই শুষিয়া যায় তাহা তো আর স্রোতের আকারে বহিয়া যাইতে পারে না। এই কারণেই রসের সচ্ছলতায় সাহিত্য হয় না, রসের উচ্ছলতায় সাহিত্যের সৃষ্টি। কতকগুলি রস আছে যাহা মানুষের প্রয়ােজনকে অনেক দূর পর্যন্ত ছাপাইয়া উৎসারিত হইয়া উঠে। তাহার মুখ্যধারা আমাদের আবশ্যকে নিঃশেষ হয় এবং গীেণধারা নানাপ্রকার ইন্দ্ৰজাল সৃষ্টি করিতে চায়। বীরপুরুষ মুখ্যভাবে তরবারিকে আপনার অস্ত্ৰ বলিয়া জানে ; কিন্তু বীরত্বগীেরব সেইটুকুতেই তৃপ্ত থাকিতে পারে নাই, সে তরবারিতে কারুকার্য ফলাইয়াছে। কলু নিজের ঘানিকে কেবলমাত্র কাজের ঘানি করিয়াই সন্তুষ্ট ; তাহার মধ্যে গীেণপ্রকাশ কিছুই নাই। ইহাতে প্রমাণ হয়, ঘানি কলুর মনে সেই ভাবের উদ্রেক করিতে পারে নাই যাহা আবশ্যক শেষ করিয়াও অনাবশকে আপনার আনন্দ ব্যক্ত করে । এই রসের অতিরিক্ততাই সংগীতকে ছন্দকে নানাপ্রকার ললিতকলাকে আশ্রয় করিতে চায়। তাঁহাই ব্যবহারের-অতীত অহেতুক হইয়া অনির্বচনীয়রূপে আপনাকে প্রকাশ করিতে চায় । নায়ক-নায়িকার যে প্রেম কেবলমাত্র দর্শনম্পর্শনের মধ্যেই গাহিয়া উঠে “জনম অবধি হম রূপ নেহারানু নয়ন না। তিরাপিত ভেল, লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখানু তবু হিয় জুড়ন না গেল। তার সে মুহুর্তকালের দেখাশুনা কেবল সেই মুহুর্তটুকুর মধ্যে নিজেকে ধারণ করিতে পারে না বলিয়াই লক্ষ লক্ষ যুগের আকাঙক্ষা সংগীতের মধ্যে সৃষ্টি না করিয়া বঁাচে না। : অতএব যে রস মানবের সর্বপ্রকার প্রয়োজনমাত্রকে অতিক্রম করিয়া বাহিরের দিকে ধাবিত হয় তাহাই সাহিত্যরস । এইরূপ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদকেই আমরা ঐশ্বৰ্য বলিয়া থাকি । সাহিত্য মানবহৃদয়ের ঐশ্বর্য। ঐশ্বৰ্যেই সকল মানুষ সম্মিলিত হয় ; যাহা অতিরিক্ত তাঁহাই সর্বসাধারণের। ময়ূরশরীরের যে উদ্যমটা অতিরিক্ত তাঁহাই তাহার বিপুল পুচ্ছে অনাবশ্যক বর্ণচ্ছটায় বিচিত্র হইয়া উঠে; এই কলাপশোভা ময়ূরের একলার নহে, তাহা বিশ্বের। প্ৰভাতের আলোকে পাখির আনন্দ যখন তাহার আহারবিহারের প্রয়োজনকে ছাপাইয়া উঠিতে থাকে তখনই সেই গানের অপরিমিত ঐশ্বৰ্যে পাখি বিশ্বসাধারণের সহিত নিজের যোগস্থাপন করে। সাহিত্যেও তেমনি মানুষ আষাঢ়ের মেঘের মতো যে রসের ধারা এবং যে জ্ঞানের ভার নিজের প্রয়োজনের মধ্যে আর ধারণ করিয়া রাখিতে পারে না তাহাকেই বিশ্বমানবের মধ্যে বর্ষণ করিতে থাকে। এই উপায়েই সাহিত্যের দ্বারাই হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়, মনের সঙ্গে মন, মিলিত হইয়া মানুষ ক্রমাগত স্বকীয়, এমন-কি স্বজাতীয়, স্বাতন্ত্র্যের উর্ধের্ব বিপুল বিশ্বমানবে পরিণত হইবার অভিমুখে চলিয়াছে। এই কারণেই আমি মনে করি আমাদের ভাষায় “সাহিত্য শব্দটি সার্থক। ইহাতে আমরা নিজের অত্যাবশ্যককে অতিক্রম করিয়া উদারভাবে মানুষের ও বিশ্বপ্রকৃতির সাহিত্য লাভ করি। কোনো দেশে যখন অতিমাত্রায় প্রয়োজনের কড়াকড়ি পড়িয়া যায় তখন সেখানে সাহিত্য নিজীব । হইয়া পড়ে। কারণ, প্রয়োজন পরকে আঘাত করে, পরকে আকর্ষণ করে না। জর্মনিতে যখন লেসিং, গ্যটে, শিলর, হাইনে, হেগেল, কান্টু, হুমবােলন্ড সাহিত্যের অমরাবতী সৃজন করিয়াছিল তখন জর্মনির বাণিজ্যতরী-রণতরী ঝড়ের মেঘের মতো পাল ফুলাইয়া পৃথিবী আচ্ছন্ন করিতে ছুটে নাই। আজ বৈশ্যযুগে জার্মািনর যতই মেদবৃদ্ধি হইতেছে ততই তাহার সাহিত্যের হৃৎপিণ্ড বলহীন হইয়া পড়িতেছে। ইংরেজও আজ নিজের ভাণ্ডার পূরণ করা, দুর্বলকে দুর্বলতর করা এবং সমস্ত পৃথিবীতে একমাত্র অ্যাংলোস্যাকশন মহিমাকেই গণ্ডারের নাসাগ্রস্থিত একশৃঙ্গের মতাে ভীষণভাবে উদ্যত রাখাকেই ধর্ম বলিয়া গণ্য করিয়াছে; তাই সেখানে সাহিত্যরঙ্গভূমিতে “একে একে নিবিছে দেউট এবং আজ প্রায় “নীরব রবাব বীণা মুরজ মুরলী । ইহা হইতে বুঝতে হইবে, যে-সকল ভাব বিশ্বমানবের অভিমুখীন তাহাই সাহিত্যকে জীবনদান