পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য AS& র্তাহারা প্রত্যেকে নিজের প্রণালীতে নিজের মন্ত্রে নিজের সরস্বতীর সেবা করিয়া থাকেন। যাহারা দশের পন্থা অনুসরণ করিয়া পুঁথিগত বাঁধা মন্ত্রে কােজ সারিতে চান দেবী কখনােই তাহাদিগকে অমৃতফল দান করেন না। সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা অনিষ্টকর। কাৰ্য্যগতিকে যাহারা এইরূপ একাধিপত্য দ্বারা পরিবেষ্টিত, কোনো কোনাে স্থলে তঁহাদের মধ্যে পরিচয় ও গ্ৰীতির অভাব, এমন-কি, ঈর্ষাকলহের সম্ভাবনা ঘটে । এক ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতার ভাব দূর করা দুঃসাধ্য। মনুষ্যস্বভাবে অনেক সংকীর্ণতা ও বিরূপতা আছে, তাহার সংশোধন প্রত্যেকের আন্তরিক ব্যক্তিগত চেষ্টার বিষয়- কোনাে কৃত্রিম প্রণালীদ্বারা তাহার প্রতিকার সম্ভবপর হইলে আমাদের অদ্যকার উদযোগের অনেক পূর্বে সত্যযুগ ফিরিয়া আসিত। দ্বিতীয় কথা, মাতৃভাষার উন্নতি । গৃহের উন্নতি বলিলেই গৃহস্থের উন্নতি বুঝায়, তেমনি ভাষার উন্নতির অর্থই সাহিত্যের উন্নতি, সাহিত্যের শ্ৰীবৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো উপায়েই ভাষা সমৃদ্ধিলাভ করিতে পারে না। কিন্তু কী করিলে সাহিত্যের উন্নতিবিধান হইতে পারে সে ভাবনা মনে উদয় হইলেও ভাবিয়া তাহার কিনারা পাওয়া কঠিন। অনাবৃষ্টির দিনে কী করিলে মেঘের আবির্ভাব হইবে সে চিন্তা মনে আসে ; কিন্তু কী করিলে মেঘের সৃষ্টি হইতে পারে তাহার সিদ্ধান্ত করা যায় না। কয়েক জনে দল বাধিয়া কেবল কয়েকটা রাশারশিতে টান মরিলেই যে প্রতিভার রঙ্গক্ষেত্রে ঠিক আমাদের ইচ্ছামত সময়েই যবনিকা উঠিয়া যাইবে, এমনতরো আশা করা যায় না। ’ তবে একটা কথা আছে। যেমন আমরা মানুষ গড়িতে পারি না বটে, কিন্তু তাহার বসনভূষণ গড়িতে পারি, তেমনি সাহিত্যের গঠনকার্যে পরামর্শম্পূর্বক হস্তক্ষেপ করা যায় না বটে, কিন্তু তাহার আয়োজনকার্য একেবারে আমাদের আয়ত্তাতীত নহে। ব্যাকরণ অভিধান ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি সংগ্ৰহ করা দলবদ্ধ চেষ্টার দ্বারা সাধ্য | চেষ্টার সূত্রপাত পূর্ব হইতেই হইয়াছে; অনুকূল সময় উপস্থিত হইলেই এই উদযোগের গীেরব একদিন সকলের নিকট সুস্পষ্ট হইয়া উঠিবে এবং বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ যে স্বদেশের কত অন্তরঙ্গ ও অন্যান্য বহুতর লোকখ্যাত মুখর অনুষ্ঠানের অপেক্ষা যে কত মহৎ এবং সত্য, একদিন তাহা নিঃসংশয়ে সপ্ৰমাণ হইবে । আমাদের দেশের পুরাবৃত্ত ভাষাতত্ত্ব লোকবিবরণ প্রভৃতি সমস্তই এ পর্যন্ত বিদেশী পণ্ডিতেরা সংগ্ৰহ এবং আলোচনা করিয়া আসিয়াছেন । বিদেশী বলিয়া তাহাদের চেষ্টা অসম্পূর্ণ এবং ভ্রমসংকুল হইতে পারে, এই কারণেই যে আমি আক্ষেপ করিতেছি। তাঁহা নহে। দেশে থাকিয়া দেশের বিবরণ সংগ্ৰহ করিতে আমরা একেবারে উদাসীন, এমন লজ্জা আর নাই। ইহা আমাদের পক্ষে কতবড়ো একটা গালি তাহা আমরা অনুভব করি না। বেদনা সম্বন্ধে সংজ্ঞা না থাকা যেমন রোগের চরম অবস্থা তেমনি যখন হীনতার লক্ষণগুলি সম্বন্ধে আমাদের চেতনাই থাকে না তখনই বুঝিতে হইবে, দুৰ্গতিপ্রাপ্ত জাতির এই লজ্জাহীনতাই চরম লজ্জার বিষয়। আমাদের দেশে এই একান্ত অসাড়তার ছােটােবড়ো প্রমাণ সর্বদাই দেখিতে পাই। বাঙালি হইয়া বাঙালিকে, পিতাম্রাতা-আত্মীয়স্বজনকে ইংরেজিতে পত্র লেখা যে কতবড়ো লাঞ্ছনা। তাহা আমরা অনুভবমাত্র করি না ; আমরা যখন অসংযত করতালিদ্বারা স্বদেশী বক্তাকে এবং হিপ হপ হুররে ধ্বনিতে স্বদেশী মানাব্যক্তিকে উৎসাহ জানাইয়া থাকি তখন সেই কৰ্ণকটু বিজাতীয় বর্বরতায় আমরা কেহ সংকোচমাত্র বােধ করি না ; যে-সকল অশ্রদ্ধাপরায়ণ পরদেশীর কোনোপ্রকার আমাদের দেবপূজায় ও বিবাহাদি শুভকর্মে গড়ের বাদ্য সহকারে প্রচুর মদ্যমাংস সেবন করানােকে উৎসবের অঙ্গ বলিয়া আমরা গণ্য করি— ইহার বীভৎসতা আমাদের হৃদয়ের কোথাও বাজে না। তেমনি আমরা আজ অন্তত বিশ-পঁচিশ বৎসর পরের সিংহদ্বারে মুষ্টিভিক্ষার জন্য প্রতিদিন নিস্ফল । যাত্রা করিয়া নিজেকে দেশহিতৈষী বলিয়া নিঃসংশয়ে স্থির করিয়াছি, অথচ দেশের দিকে একবার ফিরিয়াও তাকাই না, ইহাও একটা অজ্ঞানকৃত প্রহসন। দেশের বিবরণ জানিতে— তাহার ভাষা