পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ঐ- সেটা হাওয়ার জিনিস কিনা, তাই উক্তি দেখিতে দেখিতে অত্যুক্তি হইয়া উঠে। এখন যেন আমরা একটু বেশি তারস্বরে বলিতেছি ইংরেজের কােছ হইতে আমরা কিছুই লইব না। কেন লইব না ? দেশের হিতের জন্য যেখানে যাহা পারি সমস্ত আদায় করিব। কেবল এইটুকু পণ করিব, সেই লওয়ার পরিবর্তে নিজেকে বিকাইয়া দিব না। যাহা বিশেষভাবে ইংরেজ গবর্মেন্টের কােছ হইতেই পাইবার তাহা ষোলো-আনাই সেইখান হইতেই আদায় করিবার পর চেষ্টাই করিতে হইবে । না করিলে সে তো নিতান্তই ঠিকা। নিৰ্বদ্ধিতাই বীরত্ব নহে। কিন্তু এই আদায় করিবার কোনো জোর থাকে না, আমরা যদি নিজের দায় নিজে স্বীকার না করি । দেশের যে-সকল কাজ আমরা নিজে করিতে পারি তাহা নিজেরা সাধ্যমত করিলে তবেই আদায় করাটা যথার্থ আদায় করা হয়, ভিক্ষা করা হয় না। এ নহিলে অন্যের কাছে দাবি করার আবুই থাকে, না। কিছুকাল হইতে আমাদের সেই আৰু একেবারে ঘুচিয়া গিয়াছিল ; সেইজন্যই লজ্জাবােধটাকে এত জোর করিয়া জগাইবার একটা একান্ত চেষ্টা চলিতেছে। সকলেই জানেন, জামেকায় ভূমিকম্পের উৎপাতের পর সেখানকার কিংস্টন শহরে ভারি একটা সংকট উপস্থিত হইয়াছিল । সেই সংকটের সময় আমেরিকার রণতরীর কাপ্তেন ডেভিস তাহার মানোয়ারি গোরার দল লইয়া উপকার করিবার উৎসাহবশত কিছু অতিশয় পরিমাণে সাহায্য করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছিলেন, ইহা সেখানকার ঘোরতর দুৰ্যোগেও জামেকাদ্বীপের ইংরেজ অধ্যক্ষ সহা করিতে পারেন নাই । ইহার ভাবখানা এই যে, অত্যন্ত দুঃসময়েও পরের কাছে সাহায্য লইবার কালে নিজের ক্ষমতার অপমান করা চলে না ; তা যদি করি তবে যাহা পাই তাহার চেয়ে দিই। অনেক বেশি। পরের কাছে আনুকুলা লওয়া নিতান্ত নিশ্চিত মনে করিবার নহে । এইরূপ দান পাইয়া যদি ক্ষমতা বিক্রয় করি, আমার দেশের কাজ আমি করিবই এবং আমিই করিতে পারি। এই পুরুষোচিত অভিমান যদি অনর্গল আবেদনের অজস্র অশ্রুজলধারায় বিসর্জন দিই, তবে তেমন করিয়া পাওয়ার ধিককার হইতে ঈশ্বর যেন আমাদিগকে নৈরাশাদ্বারাই রক্ষা করেন। বস্তুত এমন করিয়া কখনোই আমরা কোনো আসল জিনিস পাইতেই পারি না । গ্রামে কোনো উৎপাত ঘটিলে আমরা রাজ-সরকারে প্রার্থনা করিয়া দুজন পুলিসের লোক বেশি পাইতে পারি, কিন্তু নিজেরাই যদি সমবেত হইয়া আত্মরক্ষার সুব্যবস্থা করিতে পারি। তবে রক্ষাও পাই, রক্ষার শক্তিও হারাইতে হয় না। বিচারের সুযোগের জন্য দরখাস্ত করিয়া আদালত বাড়াইয়া লইতে পারি, কিন্তু ” নিজেরা যদি নিজের সালিসি-সভায় মকদ্দমা মিটাইবার বন্দোবস্ত করি তবে অসুবিধারও জড় মরিয়া যায়। মন্ত্রণাসভায় দুইজন দেশী লোক বেশি করিয়া লইলেই কি আমরা রেপ্রেজেন্টেটিভ গবর্মেন্ট পাইলাম বলিয়া হরির লুট দিব ? বস্তুত আমাদের নিজের পাড়ার, নিজের গ্রামের, যথার্থ খাটি জিনিসটি আমরা পাই। অথচ এই সমস্ত অধিকার গ্রহণ করা পরের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করে না । এ আমাদের নিজের ইচ্ছা চেষ্টা ও ত্যাগ-স্বীকারের অপেক্ষা করে । আমাদের দেশ-জোড়া এই সমস্ত কাজই আমাদের পথ চাহিয়া বসিয়া আছে ; কিন্তু সে পথও আমরা মাড়াই না, পাছে সেই কর্তব্যের সঙ্গে চোখে চোখেও দেখা হয় । যাহাদের এমনি দুরবস্থা তাহারা পরের কােছ হইতে কোনো দুর্লভ জিনিস চাহিয়া লইয়া সেটাকে যথার্থভাবে রক্ষা করিতে পরিবে, এমন দুরাশা কেন তাহাদের মনে স্থান পায় ? যে কাজ আমাদের হাতের কাছেই আছে এবং যাহা আমরা ছাড়া আর-কেহই ঠিকমত সাধন করিতে পারে না, তাহাকেই সত্যরূপে সম্পন্ন করিতে থাকিলে তবেই আমরা সেই শক্তি পাইবযে শক্তির দ্বারা পরের কাছ হইতে নিঃসংকোচে আমাদের প্রাপ্য আদায় করিয়া তাহাকে কাজে খাটাইতে পারি। এইজন্যই বলিতেছি, যাহা নিতান্তই আমাদের নিজের কাজ তাহার যেটাতেই হাত দিব সেটার দ্বারাই আমাদের মানুষ হইয়া উঠিবার সহায়তা হইবে এবং মানুষ হইয়া উঠিলে তবেই আমাদের দ্বারা সমস্তই সম্ভব হইতে পরিবে । আমরা যখন প্রায় পাঁচশ-ত্রিশ বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষের প্রাচীন গৌরব লইয়া স্বদেশাভিমান অনুভব