পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२br ' | রবীন্দ্র-রচনাবলী যায়। যদি বলি “গোড়ার দিকে সুর আর-একটু নামাইয়া ধরে-না কেন তবে উত্তর পাওয়া যায়, তাহাতে লোকের মন পাইব না। হায় রে লোকের মন! তােমাকে পাইতেই হইবে বলিয়া পণ করিয়া বসাতেই তোমাকে হারাই। তোমাকে চাই না বলিরার জোর যাহার আছে সেই তোমাকে জয় করে। শুধু ছােটাে গেই বড়ো হতে থাকে, যে গােপন শুরু করতে পারে সেই প্রকাশে श्शों ७ले । r সকল দেশেরই মহত্ত্বের ইতিহাসে যেটা আমাদের চক্ষুর গােচর তাহা দাড়াইয়া আছে কিসের উপরে ? যেটা আমাদের চক্ষুর গোচর নহে তাহারই উপর। আমরা যখন নকল করিতে বসি, তখন সেই দৃষ্টিগোচরটারই নকল করিতে ইচ্ছা যায় ; যাহা চােখের আড়ালে আছে তাহা তো আমাদেব মনকে টানে না। এ কথা ভুলিয়া যাই, যাহাদের নামধাম কেহই জানে না দেশের সেই শতসহস্ৰ অখ্যাত লোকেরাই নিজের জীবনের অজ্ঞাত কাজগুলি দিয়া যে স্তর বাধিয়া দিতেছে তাহারই উপরে নামজাদা লোকেরা বড়ো বড়ো ইমারত বানাইয়া তুলিতেছে। এখন যে আমাদিগকে ভিত কাটিয়া গোড়াপত্তন করিতে হইবে- সে ব্যাপারটা তো আকাশের উপরকার নহে, তাহা মাটির নীচেকার, তাহার সঙ্গে ওয়েস্টমিনিস্টার হলের তুলনা করিবার কিছুই নাই। গোড়ায় সেই গভীরতা, তার পরে উচ্চতা । এই গভীরতার রাজ্যে স্পর্ধা নাই, ঘোষণা নাই ; সেখানে কেবল নম্রতা অথচ দৃঢ়তা, আত্মগোপন এবং আত্মত্যাগ। এই সমস্ত ভিতের কাজে, ভিতরের কাজে, মাটির সংস্রবের কাজে আমাদের মন উঠতেছে না ; আমরা একদম চুড়ার উপর জয়ডঙ্কা বাজাইয়া ধ্বজা উড়াইয়া দিতে চাই। স্বয়ং বিশ্বকর্মও তেমন করিয়া বিশ্বনির্মাণ করেন নাই। তিনিও যুগে যুগে অপরিস্ফুটকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিতেছেন। তাই বলিতেছি, সকল দেশেই গোড়ার কাজটা ঠিকমত চলিতেছে বলিয়াই ডগার কাজটা রক্ষা পাইতেছে ; নেপথ্যের ব্যবস্থা পাকা বলিয়াই রঙ্গমঞ্চের কাজ দিব্য চলিয়া যাইতেছে। স্বাস্থ্যরক্ষা অন্ন-উপার্জন জ্ঞানশিক্ষার কাজে দেশ ব্যাপিয়া হাজার-হাজার লোক মাটির নীচেকার শিকড়ের মতো প্ৰাণপণে লাগিয়া আছে বলিয়াই সে-সকল দেশে সভ্যতার এত শাখাপ্রশাখা, এত পল্লব, এত ফুলফলের প্রাচুর্য। এই গোড়াকার অত্যন্ত সাধারণ কাজগুলির মধ্যে যে-কোনো একটা কাজ করিয়া তোলাই যে আমাদের পক্ষে অসাধারণ হইয়া উঠিয়াছে। দেশের লোককে শিখাইতে হইবে, তাহার উদযোগ করিতেই প্রাণ বাহির হইয়া যায় ; খাওয়াইতে হইবে, তাহার সংগতি নাই ; রোগ দূর করিতে হইবে, সাহেব এবং বিধাতার উপর ভার দিয়া বসিয়া আছি। মািটসীনি গারিবান্ডি হ্যাম্পডেন ক্রমোয়েল হইয়া উঠাই যে একমাত্র বড়ো কাজ তাহা নহে; তাহার পূর্বে গ্রামের মোড়ল, পাঠশালার গুরুমশায়, পড়ার মুরুবি, চাষাভুষার সর্দার হইতে না পারিলে বিদেশের ইতিবৃত্তকে ব্যঙ্গ করিবার চেষ্টা একান্তই প্রহসনে পরিণত হইবে । আগে দেশকে স্বদেশ করিতে হইবে, তার পরে রাজ্যকে স্বরাজ্য করিবার কথা মুখে আনিতে পারিব। অতএব পরিষদের কাজ কী হিসাবে বড়ো কাজ, এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াে না। এ-সমস্ত গোড়াকার কাজ । ইহার ছোটোেবড়ো নাই। দেশকে ভালোবাসিবার প্রথম লক্ষণ ও প্রথম কর্তব্য দেশকে জানা, এই কথাটা আমাদের দেশ ছাড়া আর-কোনো দেশে উল্লেখমাত্র করাই বাহুল্য। পৃথিবীর অন্যত্ৰ সকলেই আপনার দেশকে বিশেষ করিয়া, তন্ন তন্ন করিয়া, জানিতেছে। না জানিলে দেশের কাজ করা যায় না। শুধু তাই নয়, এই জানিবার চর্চাই ভালোবাসার চর্চা। দেশের ছােটােবড়ো সমস্ত বিষয়ের প্রতি সচেতন দৃষ্টি প্রয়ােগ করিলেই তবে সে আমার আপনি ও আমার পক্ষে সত্য হইয়া উঠে। নইলে দেশহিত সম্বন্ধে পুঁথিগত শিক্ষা লইয়া আমরা যে সকল বড়ো বড়ো কথা বার্ক-মেকলের ভাষায় আবৃত্তি করিতে থাকি সেগুলো বড়োই বেসুরো শোনায়। তাই দেশের ভাষা পুরাবৃত্ত সাহিত্য প্রভৃতি সকল দিক দিয়া দেশকে জানিবার জন্য সাহিত্যপরিষৎ প্রবৃত্ত হইয়াছেন। বাংলাদেশের সকল জেলাই যদি তাহার সঙ্গে সচেষ্টভাবে যোগ দেন তবেই তাহার উদ্দেশ্য সফল হইবে। সফলতা দুই দিক দিয়াই হইবে- এক, যোগের সফলতা ; আর-এক, সিদ্ধির