পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বলিয়াই লাভ সহজ হইয়া সুন্দর হইয়া তাহার হাতে আপনি ধরা দেয়। '- কিন্তু এই যে সুন্দরকে খুঁজিবার কথা বলা হইল সে কী ? সে কোথায় ? সে কি একটা পেলাব সামগ্ৰী, একটা শৌখিন পদাৰ্থ ? এই কথারই উত্তরটি এই নাটকের মাঝখানে রহিয়াছে। শারদােৎসবের ছুটির মাঝখানে বসিয়া উপনন্দ তার প্রভুর ঋণ শোধ করিতেছে ; রাজসন্ন্যাসী এই প্ৰেমখণ-পরিশোধের, এই অক্লান্ত আত্মোৎসর্গের সৌন্দর্যটি দেখিতে পাইলেন। তার তখনই মনে হইল, শারদোৎসবের মূল অর্থটি এই ঋণশোধের সৌন্দর্য। শরতে এই যে নদী ভরিয়া উঠিল কুলে কুলে, এই যে খেত ভরিয়া উঠিল শস্যের ভারে, ইহার মধ্যে একটি ভাব আছে, সে এই : প্রকৃতি আপনার ভিতরে যে অমৃতশক্তি পাইয়াছে সেটাকে বাহিরে নানা রূপে নানা রসে শোধ করিয়া দিতেছে। সেই শোধ করাটাই প্রকাশ। প্রকাশ যেখানে সম্পূর্ণ হয় সেইখানেই ভিতরের ঋণ বাহিরে ভালো করিয়া শোধ করা হয় ; সেই শোধের মধ্যেই সৌন্দর্য। দেবতা আপনাকেই কি মানুষের মধ্যে দেন নাই ? সেই দানকে যখন অক্লান্ত তপস্যার অকৃপণ ত্যাগের দ্বারা মানুষ শোধ করিতে থাকে তখনই দেবতা তাহার মধ্য হইতে আপনার দান অর্থাৎ আপনাকে নূতন আকারে ফিরিয়া পান, আর তখনই কি তাহার মনুষ্যত্ব সম্পূর্ণ হইয়া উঠে না ? সেই প্ৰকাশ যতই বাধা কাটাইয়া উঠিতে থাকে ততই কি তাহা সুন্দর উজ্জ্বল হয় না ? বাধা কোথায় কাটে না ? যেখানে আলস্য, যেখানে বীর্যহীনতা, যেখানে আত্মবিমাননা। যেখানে মানুষ ১ জ্ঞানে প্রেমে কর্মে দেবতা হইয়া উঠিতে সর্বপ্রযত্নে প্রয়াস না পায় সেখানে নিজের মধ্যে সে দেবত্বের ঋণ অস্বীকার করে । যেখানে ধনকে সে আঁকড়িয়া থাকে, স্বার্থকেই চরম আশ্রয় বলিয়া মনে করে, সেখানে দেবতার ঋণকে সে নিজের ভোগে লাগাইয়া একেবারে ফুকিয়া দিতে চায়তাহাকে যে অমৃত দেওয়া হইয়াছিল, যে অমৃতের উপলব্ধিতে মৃত্যুকে তুচ্ছ করিতে পারে, ক্ষতিকে অবজ্ঞা করিতে পারে, দুঃখকে গলার হার করিয়া লয়, জীবনের প্রকাশের মধ্য দিয়া সেই অমৃতকে তখন সে শোধ করিয়া দেয় না। বিশ্বপ্রকৃতিতে ও মানবপ্রকৃতিতে এই অমৃতের প্রকাশকেই বলে সৌন্দৰ্য : আনন্দরূপমমৃতম। রাজসন্ন্যাসী উপনন্দকে দেখাইয়া দিয়া বলিয়াছেন, এই ঋণশোধেই যথার্থ ছুটি, যথার্থ মুক্তি । নিজের মধ্যে অমৃতের প্রকাশ যতই সম্পূর্ণ হইতে থাকে ততই বন্ধন মোচন হয় ; কর্মকে এড়াইয়া, তপস্যায় ফাকি দিয়া, পরিত্রাণলাভ হয় না। তাই তিনি উপনন্দকে বলিয়াছেন, “তুমি পঙক্তির পর পঙক্তি লিখছ আর ছুটির পর ছুটি পািচ্ছ।” এই লইয়া সন্ন্যাসীতে ঠাকুরদাদাতে যে কথাবার্তা হইয়াছে নীচে তাহা উদধূত করিলাম সন্ন্যাসী । আমি অনেক দিন ভেবেছি জগৎ এমন আশ্চর্য সুন্দর কেন ?- আজ স্পষ্ট প্রত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছি- জগৎ আনন্দের ঋণ শোধ করছে। বড়ো সহজে করছে না, নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সমস্ত ত্যাগ করে করছে।-- কোথাও সাধনার এতটুকু বিশ্রাম নেই, সেইজন্যেই এত সৌন্দর্য। ঠাকুরদাদা। এক দিকে অনন্ত ভণ্ডার থেকে তিনি কেবলই ঢেলে দিচ্ছেন আর-এক দিকে কঠিন দুঃখে তারই শোধ চলছে।-- এই দুঃখের জোরেই পাওয়ার সঙ্গে দেওয়ার ওজন বেশ সমান থেকে যাচ্ছে, মিলনটি সুন্দর হয়ে উঠেছে। সন্ন্যাসী। ঠাকুর্দা, যেখানে আলস্য, যেখানে কৃপণতা, যেখানেই ঋণশোধে ঢিল পড়ে যাচ্ছে, সেইখনেই সমান্ত দ। সেখােন যে এর পক্ষে আিম পরে যায় অলপক্ষের সঙ্গলি পুরে হতে পায়ন। সন্ন্যাসী। লক্ষ্মী যখন মানবের মর্তলোকে আসেন তখন দুঃখিনী হয়েই আসেন ; তঁর সেই তপস্বিনীরূপেই ভগবান মুগ্ধ। শত দুঃখের দলে তার পদ্ম সংসারে ফুটেছে।” ৩ কবি-কর্তৃক মূল নাটকের কয়েকটি বাক্য বর্জিত; সংকলিত অংশেও সামান্য পাঠভেদ আছে।