পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

A8 রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু মত যখন এমন বিষয় নিয়ে যেটা দেশের একেবারে মর্মের কথা তখন পাঠকের কাছ থেকেও অতটা বেশি নিরাসক্ত রসানুভূতি দাবি করা যায় না। তখন পাঠকের নিজের ব্যথা গল্পের ব্যথাকৈ ছাড়িয়ে ওঠে । অতএব সে জায়গায় রসের বিচারের চেয়ে রসের বিষয় বিচারটা স্বভাবতই বড়ো না হয়ে থাকতে পারে না । , আচ্ছা বেশ, তাই মানলুম। তা হলে এ স্থলে লেখকের প্রতি উপদেশটা কী ? নিজে যেটাকে ভালো মনে করি পাঠকের খাতিরে চেষ্টা করব সেটাকে মন্দ মনে করতে ? পাঠক, যদি গল্পের খাতিরে সে কাজ করতে না পারেন তা হলে লেখকই বা পাঠকের খাতিরে এমন কাজ কী করে করবেন ? ) বস্তুত খাতিরটা গল্পের ; লেখকেরও নয়, পাঠকেরও নয়। সেই গল্পের খাতিরেই নিজের হৃদয়ভােব সম্বন্ধে লেখককে নিজের হৃদয় অনুসরণ করতে হবেই এবং সেই গল্পের খাতিরেই পাঠককে. গল্পের রস অনুসরণ করতে হবে। 始 যদি বলা যায় গল্পের খাতিরের চেয়ে দেশের খাতির বড়ো, তবে সে কথা পাঠক সম্বন্ধেও যেমন খাটে লেখক সম্বন্ধেও তেমনি। তার সাময়িক একদল পাঠক তাকে বাহবা দেবে এ কথা লেখকের ভাববার নয়, তিনি ভাববেন তার গল্পটি ঠিকমত হওয়া চাই ; তাও যদি তাকে ভাবতে দেওয়া না যায়। তবে দেশের ভালো হয় এই কথাই যেন তিনি ভাবেন, দেশ তাকে ভালো বলে এ কথা নয় । আখ্যায়িকা লেখিকার দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, এই উপন্যাসের আখ্যায়িকা কি আমার কল্পনাপ্রসূত না বাস্তবে । কোথাও তার আভাস পাওয়া গেছে। যদি পেয়ে থাকি তবে সে কি আধুনিক ‘পাশ্চােত্ত্যশিক্ষাভিমানী বিলাসী সম্প্রদায়ে না প্রাচীন হিন্দুপরিবারে ? উত্তর এই ; আখ্যায়িকাটি অধিকাংশ গল্পের আখ্যায়িকার মতোই আমার কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু এইটুকুমাত্র বললেই লেখিকার প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেওয়া হয় না। ঐ প্রশ্নের মধ্যে একটি কথা চাপা আছে যে, এমন ঘটনা প্রাচীন হিন্দুপরিবারে অসম্ভব। ঠিক একটা গল্পের ঘটনা সেই গল্পের অনুরূপ অবস্থার মধ্যেই ঘটতে পারে, আর কোথাও ঘটতে পারে না- প্রাচীন বা নবীন, হিন্দু বা অহিন্দু কোনো পরিবারেই না। অতএব কোনো ৷ বিশেষ পরিবারে কী ঘটেছে সে কথা স্মরণ করে গুজব করাই চলে, গল্প লেখা চলে না। মানবচরিত্রে যে সমস্ত সম্ভবপরতা আছে সেইগুলিকেই ঘটনাবৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে গল্পে নাটকে বিচিত্র করে তোলা হয়। মানবচরিত্রের মধ্যে চিরন্তনত্ব আছে কিন্তু ঘটনার মধ্যে নেই। ঘটনা নানা আকারে নানা জায়গায় ঘটে, একই ঘটনা দুই জায়গায় ঠিক একই রকম ঘটে না। কিন্তু তার মুলে যে মানবচরিত্র আছে সে চিরকালই নিজেকে প্রকাশ করে এসেছে। এইজন্য সেই মানবচরিত্রের প্রতিই লেখক দৃষ্টি রাখেন, কোনো ঘটনার নকল করার প্রতি নয় । সাহিত্যবিচার তা হলে প্রশ্ন এই যে, প্রাচীন হিন্দুপরিবারে সর্বত্রই মানবচরিত্র কি মনুসংহিতার রাশ মেনে । চলে ? কখনো লাগাম ছিড়ে খানার মধ্যে গিয়ে পড়ে না ? আমরা বৈদিক পৌরাণিক কাল থেকে এইটেই দেখে আসছি যে, বুনো ওলের সঙ্গে বাঘা তেঁতুলের লড়াইয়ের অন্ত নেই। এক দিকে শাসনও কড়া, অন্য দিকে মানবের প্রকৃতিও উদ্দাম। তাই কখনাে শাসন জেতে, কখনাে প্রকৃতি। এই লড়াই যদি প্রাচীন হিন্দুপরিবারে