পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

না, তখন সেই আনন্দের দিনে, আশার দিনে, গৌরবের দিনে, মিলনের দিনে, যে সৌভাগ্যবান কবি বাংলাদেশে গান ধরিবেন তাহার গান জগতের মধ্যে সার্থক হইবে। বঙ্গদেশ যখন নিজের অমরত্ব নিজের মধ্যে সুস্পষ্টরূপে উপলব্ধি করিবে, নিজের সম্বন্ধে যখন তাহার কোনাে সংশয় কোনাে সংকোচ থাকিবে না, তখন নিভীক বঙ্গসাহিত্য সমস্ত সমালোচকের সমস্ত বাধি বােল, সমস্ত ইস্কুলের সমস্ত মুখস্থ গৎ অবজ্ঞােভরে উপেক্ষা করিয়া নিজের অন্তরের মহান আদর্শ অবলম্বন করিয়া অপূর্ব কারুকৌশলে আপনূনবীন দেবমন্দ্বিরকে অভ্ৰভেদী করিয়া তুলিবে এবং মুহুর্তের মধ্যে তাহাকে প্রাচীনের চিরন্তন মহিমা সমৰ্পণ করিবে। আমরা নিজের অবস্থা-গণ্ডির মধ্যে বদ্ধ হইয়া যাহা পারিয়াছি তাহাই করিয়াছি, যােহা শিখিয়াছি তাহাই বকিয়াছি, যাহা সম্মুখে পাইয়াছি তাহাই বিহিত নিয়মে সাজাইয়া গেছি। আমাদের রচনা বাংলার বর্তমান ভিত্তির মধ্যে এখনো কোনাে নূতন গবাক্ষ কাটিয়া কোনাে নূতন আলোক, আনে নাই, কোনাে নূতন আশায় দেশকে প্লাবিত করে নাই, সাহিত্যকে এমন একটি প্রাণশক্তি দেয় নাই যে শক্তিবলে আমাদের সাহিত্য দেশের ও বিদেশের পক্ষে চিরকালের জন্য প্রাণের সৌন্দর্যের ও কল্যাণের অক্ষয় । ভাণ্ডার হইয়া থাকে । কিন্তু অন্তরের মধ্যে অনুভব করিতেছি, সেদিন দূরে নাই। সমস্ত অনুকরণ-অনুসরণকে তুচ্ছ করিয়া দিয়া নিজেকে নিজে লাভ করিবার জন্য আমাদের হৃদয়ের মধ্যে তীব্ৰ বেদনা উপস্থিত হইয়াছে। মরুভূমির মধ্যে ক্ষুধাতুর তৃষার্তের স্কন্ধে টাকার থলি। যেমন কেবল ভারমাত্র তেমনি বিদেশের যে-সমস্ত বহুমূল্য বোঝা আমরা মাথায় চাপাইয়াছি, বুঝিতে পারিতেছি, তাহার মূল্য যতই হােক, তাহা আমাদের বল অপহরণ করিতেছে ; এখন মন কেবলই বলিতেছে ; চাহি না, চাহি না, এ-সমস্ত কিছুই চাহি না । তবে কী চাই ? হৃদয়ের মধ্য হইতে এই প্রার্থনা উর্ধ্বস্বরে কঁদিয়া উঠিতেছে ; আপনাকে চাই! চাই আপনার শক্তিকে ! প্রচুর হইলেও উপকরণমাত্রে কোনো লাভ নাই, তাহা আবর্জনা । সভা সমিতি দরখাস্ত ও কনগ্রেসে যে আমাদিগের হীনতা হইতে মুক্তি দিতে পারে এ মোহ আমাদের মন হইতে চলিয়া যাইতেছে, গবর্মেন্ট অনুগ্রহপূর্বক উচ্চ আসনে চড়াইয়া আমাদিগকে বড়ো করিতে পারে এই মিথ্যা। আশাও শিথিল হইয়া আসিয়াছে। এখনি যথার্থ সময় । এখনি মনে হইতেছে, কোনো মহাপুরুষের আবির্ভাব আসন্ন । হইয়াছে- যিনি ভারতবর্ষের সম্মুখে ভারতবর্ষের পথ উদঘাটিত করিয়া দিবেন ; যিনি আমাদের অন্তরের মধ্যে এই কথা ধ্বনিত করিয়া তুলিবেন যে, আমরা ভারতবাসী, আমরা ফিরিঙ্গি নই, ” আমরা বর্বর নই, আমাদের লজ্জার কোনো কারণ নাই ; যিনি আমাদের মনকে, আমাদের হৃদয়কে, আমাদের কল্পনাকে স্বাধীন করিয়া দিবেন ; যিনি আমাদের শিক্ষার বন্ধন মোচন করিবেন, আমাদের বিদেশী সংস্কারের সমস্ত কুহেলিকা অপসারিত করিয়া দিবেন। তখন আমাদের বর্তমান অবস্থা যেমনি থাক, আমাদের চিত্ত তাহার বহু উর্ধে উঠিয়া সমস্ত বিশ্বজগৎকে প্রত্যক্ষ আপনার সম্মুখে প্রসারিত দেখিবো। এমন মুক্তি আছে যাহাকে রাজার শাসন, প্রবলের পীড়ন, অবস্থার পেষণ স্পর্শ করিতে পারে না। সেই মুক্তিই ভারতবর্ষের লক্ষ্যস্থল ছিল এবং সকল ক্ষুদ্রতা ও স্বার্থচেষ্টার আক্রমণ হইতে সেই রত্নকে রক্ষা করিবার ভার লইয়াই ব্ৰাহ্মণ ভারতবর্ষে গৌরব লাভ করিয়াছিলেন এবং সেই রত্ন হারাইয়াই ব্ৰাহ্মণ ও ভারতবর্ষ রসাতলে গেছে। সেই মুক্তির আশা ও আনন্দ যখন অরুণালোকের ন্যায় আমাদের মাতৃভূমির উদয়াচল স্পর্শ করবে তখন যে অপরূপ সংগীত চতুর্দিক হইতে ধ্বনিত উদগীত