পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় ауe করে সেই পুত্র । পুৎনামক কোনো-একটি নরক হইতে ত্ৰাণ করে এই ব্যাখ্যাটি পরবর্তী কালে আমাদের পুরাণে স্থান পাইয়াছে। - পিতাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলে বলিয়াই পুত্রের গীেরব । পুত্র পিতার অকৃত কর্মগুলিকে সম্পন্ন করে, তাহার ভারকে বহন করে, তাহার ঋণকে পরিশোধ করিয়া দেয়। এই কারণেই, কেবলমাত্র স্নেহপ্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্য নহে, কল্যাণপ্ৰাপ্তির জন্য, অকৃতাৰ্থতা ও অসমাপ্তি হইতে মুক্তিলাভের জন্যই, পুত্রকে আমাদের দেশে দেবতার বিশেষ প্ৰসাদ লাভের মতোই গণ্য করিত। আমাদের দেশ বহুকাল হইতে পুত্ৰহীন হইয়া শোক করিতেছে। সে যাহা আরম্ভ করে তাহা কোনো-একটি ব্যক্তিকেই আশ্রয় করিয়া দেখা দেয় এবং সেই একটি ব্যক্তির সঙ্গেই বিলীন হইয়া যায়- তাহার সংকল্পকে বিচিত্র। সার্থকতার পরম্পরার মধ্য দিয়া ভাবী পরিণামের দিকে বহন করিয়া লইয়া যাইবার কোনো উপায় নাই। ক্ষুদ্রতা, বিচ্ছিন্নতা, অসমাপ্তি কেবলই দেশের ঋণের বোঝা বাড়াইয়াই চলিয়াছে ; কোনােটাই পরিশোধ হইবার কোনাে সুলক্ষণ দেখা যাইতেছে না। এই সম্পূর্ণতাহীন খণ্ডতাশাপগ্ৰস্ত বন্ধ্যদশা ঘুচাইবার জন্য আমাদের অভাগা দেশ কামনা করিতেছিল। কারণ, বন্ধত্বমাত্রই বন্ধন। যে ব্যক্তি নিজের ফল ফলাইতে পারিল না সে নিস্কৃতি পাইল কই ? আমাদের দেশের অভ্যন্তরে যে অভিপ্রায় রহিয়াছে সেই অভিপ্রায় যদি চারিদিকে সফলতার বিচিত্র রূপ ধারণ করিয়া উঠিতে না থাকে, যদি তাহা কেবল গুপ্তই থাকিয়া যায়, যদি তাহা অঙ্কুরিত হইয়াই শুকাইতে থাকে, তবে এমন কোনো অকৃত্রিম উপায় নাই যাহার সাহায্যে দেশ মুক্তিলাভ করিতে পারিবে। যাহারা নিরন্তর কালের মধ্য দিয়া অবিচ্ছিন্নভাবে দেশের সংকল্পকে সিদ্ধির পথে, মুক্তির পথে লইয়া যাইবে তাহারাই দেশের পুত্র। দুঃখিনী বঙ্গভূমি সেই পুত্ৰ কামনা করিতেছিল। আমাদের দেশমাতাকে বহু পুত্ৰবতী হইতে হইবে। এই পুত্রদের কেহ বা দেশের জ্ঞানকে, কেহ বা দেশের ভাবকে, কেহ বা দেশের কর্মকে অনুবৃত্তি দান করিয়া তাহাকে উত্তরোত্তর পরিপূর্ণ করিয়া তুলিবে। তাহারা নানা লোকের উদ্যমকে এক স্থানে আকর্ষণ করিয়া লইবে, তাহারা নানা কালের চেষ্টাকে একত্রে বঁাধিয়া চলিবে । তাহারা দেশের চিত্তকে নানা ব্যক্তির মধ্যে ব্যাপ্ত করিয়া দিবে এবং অনাগত কালের মধ্যে বহন করিয়া চলিবে। এমনি করিয়াই দেশের বন্ধ্যা অবস্থার সংকীর্ণতা ঘুচিয়া যাইবে, সে জ্ঞানে প্রেমে কর্মে সকল দিকেই পরিপূর্ণ হইয়া উঠিবে। এইরূপ পুত্রের জন্য বঙ্গভূমির কামনা জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে, পুত্রেষ্টিযজ্ঞ আরম্ভ হইয়াছে। , বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎকে আমি দেশমাতার এইরূপ একটি পুত্র বলিয়া অনুভব করিয়া অনেক দিন হইতে আনন্দ পাইতেছি। ইহা একটি বিশেষ দিকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতা ঘুচাইয় তাহাকে সম্পূর্ণতা দান করিবার জন্য অবতীর্ণ হইয়াছে। তাহা বাংলাদেশের আত্মপরিচয়চেষ্টাকে এক জেলা হইতে অন্য জেলায় ব্যাপ্ত করিয়া দিবে, এক কাল হইতে অন্য কালে বহন করিয়া চলিবে- তাহার এক নিত্যপ্রসারিত জিজ্ঞাসা সূত্রের দ্বারা আদ্যকার বাঙালির চিত্তের সহিত দূরকালের বাঙালিচিত্তকে মালায় গাঁথা চলিবে- দেশের সঙ্গে দেশের, কালের সঙ্গে কালের যোগসাধন করিয়া পরিপূর্ণতা বিস্তার করিতে থাকিবে । পুত্র পিতৃবংশকে, পিতৃকীর্তিকে, পিতৃসাধনকে এইরূপে ভবিষ্যতের অভিমুখে অগ্রসর করিয়া দিয়া অতীতের সহিত অনাগতকে এক করিয়া মানুষকে কৃতাৰ্থ করে ; দেশপুত্রও দেশের চিত্তকে, দেশের চেষ্টাকে, বৃহৎ দেশে বৃহৎ কালে ঐক্য দান করিয়া তাহাকে সত্য করে- তাহাকে চরিতার্থ করে। সাহিত্যপরিষৎও বাংলাদেশের চিত্তকে এইরূপ নিত্যতা দান করিয়া তাহাকে মহৎ রূপে সত্য করিয়া তুলিবার আশা বহন করিয়া আনিয়াছে বলিয়াই আমরা তাহার অভ্যুদয়কে বাংলাদেশের পূণ্যফল বলিয়া গণনা कब्रिडछि । ኧ আমাদের এই সাহিত্যপরিষৎ এতদিন গর্ভবাসে ছিল। সে অল্পে অল্পে রসে রক্তে পরিপুষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। তাহার সুহৃদগণ তাহাকে নানা আঘাত-অপঘাত হইতে সযত্নে বঁাচাইয়া