পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ । ३११ প্রাচীরবং শত্রুসৈন্তের এক দুর্বল অংশ লক্ষ্য করিয়া সমস্ত সৈন্ত বিষ্ক্যাবেগে ছুটাইয়া দিলেন। পালাইবার পথ রুদ্ধ দেখিয়া সৈন্তেরা উন্মত্তের স্তায় লড়িতে লাগিল। ইশা খী দুই হাতে দুই তলোয়ার লইলেন–র্তাহার চতুস্পার্থে একটি লোক তিষ্ঠিতে পারিলন । যুদ্ধক্ষেত্রের একস্থানে একটি ক্ষুত্র উৎস উঠিতেছিল তাহার জল রক্তে লাল হইয়া উঠিল। ইশা খাঁ শত্রুর ব্যুহ ভাঙিয়া ফেলিয়া লড়িতে লড়িতে প্রায় পর্বতের শিখর পর্যন্ত উঠিয়াছেন, এমন সময় এক তীর আসিয়া তাহার বক্ষে বিদ্ধ হইল । তিনি আল্লার নাম উচ্চারণ করিয়া ঘোড়ার উপর হইতে পড়িয়া গেলেন। যুবরাজের জাহতে এক তীর, পৃষ্ঠে এক তীর এবং তাহার বাহন হাতির পরে এক তাঁর বিদ্ধ হইল। মাহুত হত হইয়া পড়িয়া গিয়াছে। হাতি যুদ্ধক্ষেত্র ফেলিয়া উন্মাদের মতো ছুটিতে লাগিল। যুবরাজ তাহাকে ফিরাইবার অনেক চেষ্টা করিলেন, সে ফিরিল না। অবশেষে তিনি যন্ত্রণায় ও রক্তপাতে দুর্বল হইয়া যুদ্ধক্ষেত্র হইতে অনেক দূরে কর্ণফুলি নদীর তীরে হাতির পিঠ হইতে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলেন। একাদশ পরিচ্ছেদ আজ রাত্রে চাদ উঠিয়াছে। অন্যদিন রাত্রে যে সবুজ মাঠের উপরে টাদের আলো বিচিত্রবর্ণ ছোটে। ছোটো বনফুলের উপর আসিয়া পড়িত, আজ সেখানে সহস্ৰ সহস্ৰ মাহুষের হাতপা কাটামুগু ও মৃতদেহের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে—যে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ উৎসের জলে সমস্ত রাত ধরিয়া চন্দ্রের প্রতিবিম্ব নৃত্য করিত, সে উৎস মৃত অশ্বের দেহে প্রায় রুদ্ধ--তাহার জল রক্তে লাল হইয়া গেছে। কিন্তু দিনের বেলা মধ্যাহ্নের রেীত্রে যেখানে মৃত্যুর ভীষণ উৎসব হইতেছিল, ভয় ক্রোধ নিরাশা হিংসা সহস্ৰ হৃদয় হইতে অনবরত ফেনাইয়া উঠিতেছিল, অস্ত্রের ঝন ঝন উন্মাদের চীৎকার আহতের আর্তনাদ অশ্বের হ্যে রণশম্বের ধ্বনিতে নীল আকাশ যেন মথিত হইতেছিল—রাত্রে চাদের আলোতে খোনে কী অগাধ শান্তি কী স্বগভীর বিষাদ । মৃত্যুর মৃত্য যেন ফুরাইয়া গেছে, কেবল প্রকাও নাট্যশালার চারিদিকে উৎসবের ভগ্নাবশেষ পড়িয়া আছে। সাড়াশব্দ নাই, প্রাণ নাই, চেতনা নাই, হৃদয়ের তরঙ্গ স্তব্ধ। একদিকে পর্বতের সুদীর্ঘ ছায়া পড়িয়াছে—একদিকে চাদের আলো । মাঝে মাঝে পাচ-ছয়টা করিয়া বড়ো বড়ে গাছ ঝাকড়া মাখা লইয়া শাখাপ্রশাখা জটাজট আঁধার করিয়া স্তন্ধ হইয়া দাড়াইয়া আছে ।