পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শাস্তিনিকেতন vEO অগ্রসর হতে হতে । সে প্রত্যেকবার অগ্রসর হয়ে বলে, না এখনও শেষ হল না । সে যদি চুপ করে পড়ে থাকত তাহলে বৃহন্ধের সঙ্গে কেবলমাত্র নিজের বৈপরীত্যটুকুই জানত কিন্তু সে নাকি চলেছে এই চলার দ্বারাই বৃহত্ত্বর্কে পদে পদে উপলদ্ধি করে চলেছে। এই চলার দ্বারা মাপকাঠি ক্ষুত্র হয়েও বৃহত্ত্বকে প্রচার করছে। এইরূপে ক্ষুত্রে বৃহতে বৈপৰীত্যের মধ্যে যেখানে একটা সামঞ্জস্ত ঘটছে সেইখানেই ক্ষুত্রের দ্বারা বৃহতের প্রকাশ হচ্ছে । I জগৎও তেমনি সীমাবদ্ধভাবে কেবল স্থির নিশ্চল নয়—তার মধ্যে নিরস্তর একটি অভিব্যক্তি আছে একটি গতি আছে। রূপ হতে রূপান্তরে চলতে চলতে সে ক্রমাগতই বলছে আমার সীমার দ্বারা তার প্রকাশকে শেষ করতে পারলুম না । এইরূপে রূপের দ্বারা জগৎ সীমাবদ্ধ হয়ে গতির দ্বারা অসীমকে প্রকাশ করছে। রূপের সীমাটি না থাকলে তার গতিও থাকতে পারত না, তার গতি না থাকলে অসীম তো অব্যক্ত হয়েই থাকতেন । আত্মার প্রকাশরুপ যে অহং তার সঙ্গে আত্মার একটি বৈপরীত্য আছে | আত্মা ন জায়তে ম্ৰিয়তে । না জন্মায় না মরে । অহং জন্মমরণের মধ্য দিয়ে চলেছে । আত্মা দান করে, অহং সংগ্রহ করে, আত্মা অন্তরের মধ্যে সঞ্চরণ করতে চায়, অহং বিষয়ের মধ্যে আসক্ত হতে থাকে । এই বৈপরীত্যের বিরোধের মধ্যে যদি একটি সামঞ্জস্ত স্থাপিত না হয় তবে অহং আত্মাকে প্রকাশ না করে তাকে আচ্ছন্নই করবে। - অহং আপনার মৃত্যুর দ্বারাই আত্মার অমরত্ব প্রকাশ করে । কোনো সীমাবদ্ধ পদার্থ নিশ্চল হয়ে এই অমর আত্মাকে নিজের মধ্যে একভাবে রুদ্ধ করে রাখতে পারে না। অহং-এর মৃত্যুর দ্বারা আত্মা রূপকে বর্জন করতে করতেই নিজের রূপাতীত স্বরূপকে প্রকাশ করে। রূপ কেবলই বলে, একে আমি বাধতে পারলুম না, এ আমাকে নিরস্তুর ছাড়িয়ে চলছে। এই জন্মমৃত্যুর দ্বারগুলি আত্মার পক্ষে রুদ্ধ দ্বার নয় । সে যেন তার রাজপথের বিজয়তোরণের মতে, তার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে করতে সে চলে যাচ্ছে, এগুলি কেবল তার গতির পরিমাপ করছে মাত্র । অহং নিয়ত চঞ্চল হয়ে আত্মাকে কেবল মাপছে আর কেবলই বলছে—না, একে আমি সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারলুম না। সে যেমন সব জিনিসকেই বদ্ধ করে রাখতে চায় তেমনি আত্মাকেও সে বাধতে চায়। বদ্ধ করতে চাওয়াই তার ধর্ম । অথচ একেবারে বদ্ধ করে রাখা তার ক্ষমতার মধ্যে নেই। যেমন বদ্ধ করা তার প্রবৃত্তি তেমনি বদ্ধ করাই যদি তার ক্ষমতা হত তবে অমন সর্বনেশে জিনিস আর কী হত ।