পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

y obr. রবীন্দ্র-রচনাবলী একাদশ পরিচ্ছেদ সমস্তদিন মেঘ-মেঘ করিয়া আছে, বিন্দু-বিন্দু বৃষ্টি পড়িতেছে, বাদলার আর্দ্র বাতাস বহিতেছে। আজ করুণা মন্দিরে মহাদেবের পূজা করিতে গিয়াছে। কঁাদিয়া-কাটিয়া প্রার্থনা করিল- যেন তাহাকে আর অধিক দিন। এরূপ কষ্টভোগ করিতে না হয় ; এবার তাহার যে সন্তান হইবে সে যেন পুত্র হয়, কন্যা না হয় ; নারীজন্মের যন্ত্রণা যেন আর কেহ ভোগ না করে | করুণা প্রার্থনা করিল- তাহার মরণ হউক, তাহা হইলে নরেন্দ্র স্বেচ্ছামতে অকণ্টকে সুখ ভোগ করিতে পাইবে । এই দুঃখের সময় নরেন্দ্রের এক পুত্র জন্মিল। অর্থের অনটনে সমস্ত খরচপত্র চলিবে কী করিয়া তাহার ঠিক নাই। নরেন্দ্রের পূর্বকার চাল কিছুমাত্র বিগড়ায় নাই। সেই সন্ধ্যাকালে গদাধর ও স্বরূপের সহিত বসিয়া তেমনি মদটি খাওয়া আছে- তেমনি ঘড়িটি, ঘড়ির চেনাটি, ফিনফিনে ধুতিটি, এসেন্সটুকু, আতরটুকু, সমস্তই আছে- কেবল নাই অর্থ। করুণার গাৰ্হস্থ্যুপটুতা কিছুমাত্র নাই ; তাহার সকলই উলটাপালটা, গোলমাল। গুছাইয়া কী করিয়া খরচপত্র করিতে হয় তাহার কিছুই জানে না, হিসাবপত্রের কোনো সম্পর্কই নাই, কী করিতে যে কী করে তাহার ঠিক নাই | করুণা যে কী গোলে পড়িয়াছে তাহা সেই জানে। নরেন্দ্র তাহাকৈ কোনো সাহায্য করে না, কেবল মাঝে মাঝে গালাগালি দেয় মাত্ৰ— নিজে যে কী দরকার, কী অদরকার, কী করিতে হইবে, কী না করিতে হইবে, তাহার কিছুই ভাবিয়া পায় না । করুণা রাত দিন ছেলেটি লাইয়া থাকে বটে, কিন্তু কী করিয়া সন্তান পালন করিতে হয় তাহার কিছু যদি জানে। ভবি বলিয়া বাড়ির যে পুরাতন দাসী ছিল সে করুণার এই দুৰ্দশায় বড়ো কষ্ট পাইতেছে। করুণাকে সে নিজহস্তে মানুষ করিয়াছে, এই জন্য তাঁহাকে সে অত্যন্ত ভালোবাসে। নরেন্দ্রের অন্যায়ীচরণ দেখিয়া সে মাঝে মাঝে নরেন্দ্রকে খুব মুখনাড়া দিয়া আসিত, হাত মুখ নাড়িয়া যাহা না বলিবার তাহা বলিয়া আসিত । নরেন্দ্ৰ মহারুষ্ট হইয়া কহিত, “তুই বাড়ি হইতে দূর হইয়া যা !” সে কহিত, “তোমার মতো পিশাচের হস্তে করুণাকে সমর্পণ করিয়া কোন প্ৰাণে চলিয়া যাই ?” অবশেষে নরেন্দ্ৰ উঠিয়া দুই-চারিটি পদাঘাত করিলে পরে সে গর গর করিয়া বকিতে বকিতে কখনো বা কাদিতে কঁদিতে সেখান হইতে চলিয়া যাইত । ভবিই বাড়ির গিন্নি, সেই বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম করিত, করুণাকে কোনো কাজ করিতে দিত না । করুণার এই অসময়ে সে যাহা করিবার তাহা করিয়াছে। ভবির আর কেহ ছিল না। যাহা-কিছু অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিল, সমস্ত করুণার জন্য ব্যয় করিত | করুণা যখন একলা পড়িয়া পড়িয়া কঁাদিত তখন সে তাহাকে সাস্তুনা দিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিত। করুণাও ভবিকে বড়ো ভালোবাসিত ; যখন মনের কষ্ট্রের উচ্ছস ।চাপিয়ারাখিতে পারিত না, তখন দুই হস্তে ভবির গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া এমন কঁদিয়া উঠিত যে, ভবিও আর অশ্রুসংবরণ করিতে পারিত না, সে শিশুর মতো কাদিয়া একাকার করিয়া দিত । ভবি না থাকিলে করুণা ও নরেন্দ্রের কী হইত বলিতে পারি না । দ্বাদশ পরিচ্ছেদ স্বরূপবাবুকহেন যে, পৃথিবী তীহাকে ক্রমাগতই জ্বালাতন করিয়া আসিয়াছে, এই নিমিত্ত মানুষকে তিনি পিশাচ জ্ঞান করেন। কিন্তু আমরা যতদূর জানি তাহাতে তিনিই দেশের লোককে জ্বালাতন করিয়া আসিতেছেন । তিনি যাহার সহিত কোনো সংশ্রবে। আসিয়াছেন তাহাকেই অবশেষে এমন গোলে ফেলিয়াছেন যে, কী বলিব । স্বরূপবাবু সর্বদা এমন কবিত্বাচিন্তায় মগ্ন থাকেন যে, অনেক ডাকাডাকিতেও তাহার উত্তর পাওয়া যায় না ও সহসা “অ্যা বলিয়া চমকিয় উঠেন। হয়তো অনেক সময়ে কোনো পুষ্করিণীর বাধা ঘাটে বসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া আছেন, অথচ যে সম্মুখে পশ্চাতে পার্থে মানুষ আছে তাহা টেরও পািন