পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ο Σ. 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী নয়নে বাড়ির দিকে চাহিয়া রহিল। প্রাচীরের বাহির হইয়া দেখিল- তাহার সেই বাগানের গাছপালা নীরবে দাড়াইয়া আছে। দেখিল— দ্বিতীয় তলের যে গৃহে তাহার পিতা থাকিতেন, যে গৃহে সে তাহার পিতার সহিত কতদিন খেলা করিয়াছে, সে গৃহের দ্বার সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, ভিতরে একটি ভগ্ন খাট পড়িয়া আছে, তাহার সম্মুখে নিস্তেজ একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে। কতক্ষণের পর নিশ্বাস ফেলিয়া করুণা ফিরিয়া দাড়াইল। গ্রামের পথে চলিতে আরম্ভ করিল। কতক দূর গিয়া আর একবার ফিরিয়া চাহিল, দেখিল সেই বিজন কক্ষে একটিমাত্র মুমূর্ষ প্রদীপ জ্বলিতেছে। ছেলেবেলা যাহার করুণাকে সুখে খেলা করিতে দেখিয়াছে তাহারা সকলেই আপনি কুটীরে নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতেছে। তাঁহাদের সেই কুটীরের সম্মুখ দিয়া ধীরে ধীরে করুণা চলিয়া গেল। আর একবার ফিরিয়া চাহিল, দেখিল তাহার পিতার কক্ষে এখনো সেই প্ৰদীপটি জ্বলিতেছে। সেই গভীর নীরব নিশীথে অসংখ্য তারকা নিমেষহীন স্থির নেত্ৰে নিম্নে চাহিয়া দেখিল— দিগন্তপ্রসারিত জনশূন্য অন্ধকার মাঠের মধ্য দিয়া একটি রমণী একাকিনী চলিয়া যাইতেছে। সপ্তদশ পরিচ্ছেদ পণ্ডিতমহাশয় সকালে উঠিয়া দেখিলেন কাত্যায়নী ঠাকুরানী গৃহে নাই। ভাবিলেন গৃহিণী বুঝি পাড়ার কোনো মেয়েমহলে গল্প ফাদিতে গিয়াছেন। অনেক বেলা হইল, তথাপি তাহার দেখা নাই। তা, মাঝে মাঝে প্রায়ই তিনি এরূপ করিয়া থাকেন । কিন্তু পণ্ডিতমহাশয় আর বেশিক্ষণ স্থির থাকিতে পারিলেন না, যেখানে-যেখানে ঠাকুরানীর যাইবার সম্ভাবনা ছিল খোজ লইতে গেলেন। মেয়েরা চোখ-টেপটিপি করিয়া হাসিতে লাগিল ; কহিল, “মিনসা এক দণ্ড আর কাত্যায়নী-পিসিকে ছাড়িয়া থাকিতে পারে না! কোথায় গিয়াছে বুঝি, তাই খুঁজতে বাহির হইয়াছেন। কিন্তু পুরুষমানুষের অতটা ভালো দেখায় না ।” তাহার মানে, তাহাদের স্বামীরা অতটা করেন না, কিন্তু যদি করিতেন তবে বড়ো সুখের হইত। যেখানে কাত্যায়নীর যাইবার সম্ভাবনা ছিল সেখানে তো পণ্ডিতমহাশয় খুঁজিয়া পাইলেন না, যেখানে সম্ভাবনা ছিল না। সেখানেও খুঁজতে গেলেন— সেখানেও পাইলেন না। এই তো পণ্ডিতমহাশয় ব্যাকুল হইয়া মুহুরমুহু নস্য লইতে লাগিলেন। উর্ধর্বশ্বাসে নিধিদের বাড়ি গিয়া পন্ডিলেন । খোজ লইয়াছেন ? এইরূপে মুখুজে চাটুজ্জে বাড়জে ইত্যাদি যত বাড়ি জানিত প্রায় সকলগুলিরই উল্লেখ করিল, কিন্তু সকল-তাতেই অমঙ্গল উত্তর পাইয়া কিয়ৎক্ষণের জন্য ভাবিতে লাগিল । অবশেষে নিধি নিজে নরেন্দ্রের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইল। শূন্য গৃহ যেন হা হা করিতেছে। বিষন্ন বাড়ির চারি দিক যেন কেমন অন্ধকার হইয়া আছে, একটা কথা কহিলে দশটা প্ৰতিধ্বনি যেন ধমক দিয়া উঠিতেছে। একটা চাকর রুদ্ধ দ্বারের সম্মুখে সোপানের উপর পড়িয়া পড়িয়া ঘুমাইতেছিল, নিধি তাহাকে জাগাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “গদাধরবাবু কোথায় ।” সে কহিল, “কাল রাত্রে কোথায় চলিয়া গিয়াছেন, আজও আসেন নাই- বোধ হয়। কলিকাতায় গিয়া থাকিবেন ।” নিধি ফিরিয়া আসিয়া পণ্ডিতমহাশয়কে কহিল, “যদি খুজিতে হয় তো কলিকাতায় গিয়া খোজো গে৷ ” পণ্ডিতমহাশয় তো এ কথার ভােবই বুঝিতে পারিলেন না। নিধি কহিল, “গদাধর নামে একটি বাবু আসিয়াছেন, দেখিয়াছ ?” পণ্ডিতমহাশয় শূন্যগর্ভ একটি হাঁ দিয়া গেলেন। নিধি কহিল, “সেই ভদ্রলোকটির সঙ্গে কাত্যায়নী পিসি কলিকাতা ভ্ৰমণ করিতে গিয়াছেন।”