পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ A YG পণ্ডিতমহাশয়ের মুখ শুকাইয়া গেল, কিন্তু তিনি এ কথা কোনোক্রমেই বিশ্বাস করিতে চাহিলেন না । তিনি কহিলেন, তিনি নন্দীদের বাড়ি ভালো করিয়া দেখেন নাই, সেখানেই নিশ্চয় আছেন । এই বলিয়া। নদী আদি করিয়া আর-একবার সমস্ত বাড়ি অন্বেষণ করিয়া আসিলেন, কোথাও সন্ধান পাইলেন না । মানবদনে বাড়িতে ফিরিয়া আসিলেন । - নিধি কহিল, “আমি তাে পূর্বেই বলিয়াছিলাম যে, এরূপ ঘটবে।” কিন্তু তিনি পূর্বে কোনােদিন এ সম্বন্ধে কোনো কথা বলেন নাই। সিন্দুক খুলিতে গিয়া পণ্ডিতমহাশয় দেখিলেন, কাত্যায়নী ঠাকুরানী শুদ্ধ যে নিজে গিয়াছেন এমন নহে, যতী-কিছু গহনাপত্র টাকাকড়ি ছিল তাহার সমস্ত লইয়া গিয়াছেন। দ্বার রুদ্ধ করিয়া পণ্ডিতমহাশয় সমস্ত দিন কঁদিলেন । নিধি কহিল, “এ সমস্তই নরেন্দ্রের ষড়যন্ত্রে ঘটিয়াছে, তাহার নামে নালিশ করা হউক, আমি সাক্ষী তৈয়ার করিয়া দিব ।” নিধি এরূপ একটা কাজ হাতে পাইলেই বাচিয়া যায়। পণ্ডিতমহাশয় কহিলেন, যাহা তাহার ভাগ্যে ছিল হইয়াছে, তাই বলিয়া তিনি নরেন্দ্রের নামে নালিশ করিতে পারেন না। নিধিকে লইয়া পণ্ডিতমহাশয় কলিকাতায় আসিলেন । একদিন দুই প্রহরের রৌদ্রে পণ্ডিতমহাশয়ের শ্ৰান্ত স্কুল দেহ কালীঘাটের ভিড়ের তরঙ্গে হাবুডুবু খাইতেছে, এমন সময়ে সম্মুখে একটি সেকেন্ড ক্লাসের গাড়ি আসিয়া দাড়াইল। পণ্ডিতমহাশয়ের মন্দির দেখা হইয়াছে, কালীঘাট হইতে চলিয়া যাইবেন তাহার চেষ্টা করিতেছেন। গাড়ি দেখিয়া তাহা অধিকার করিবার আশায় কোনোপ্রকারে ভিড় ঠেলিয়া-ঠুলিয়া সেই দিকে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন গাড়ি হইতে প্রথমে একটি বাবু ও তাহার পরে একটি রমণী হাসিতে হাসিতে, পান চিবাইতে চিবাইতে, গাড়ি হইতে নামিলেন ও হেলিতে দুলিতে মন্দিরাভিমুখে চলিলেন। পণ্ডিতমহাশয় সে রমণীকে দেখিয়া অবাক হইয়া গেলেন। সে রমণীটি তাড়াতাড়ি ছুটিয়া তাহার পার্থে আসিয়া উপস্থিত হইলেন- কাত্যায়নী তাহার উচ্চতম স্বরে কহিলেন, “কে রে মিনসে । গায়ের উপর আসিয়া পড়িস যে ! মরণ আর-কি!” এইরূপ অনেকক্ষণ ধরিয়া নানা গালাগালি বর্ষণ করিয়া অবশেষে পণ্ডিতমহাশয় তাহার ‘চোখের মাতা' খাইয়াছেন কি না ও বুড়া বয়সে এরূপ অসদাচরণ করতে লজ্জা করেন কি না জিজ্ঞাসা করিলেন। পণ্ডিতমহাশয় দুইটি প্রশ্নের কোনােটির উত্তর না দিয়া হাঁ করিয়া দাড়াইয়া রহিলেন, তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল, মনে হইল যেন এখনি মুছিত হইয়া পড়িবেন । কাত্যায়নীর সঙ্গে যে বাবু ছিলেন তিনি ছুটিয়া আসিয়া তাহার স্টকের বাড়ি পণ্ডিতমহাশয়কে দুই একটা গোজা মারিয়া ও বিজাতীয় ভাষায় যথেষ্ট মিষ্ট সম্ভাষণ করিয়া, ইংরাজি অর্ধস্ফুট স্বরে ‘পাহারাওয়ালা পাহারাওয়ালা করিয়া ডাকাডাকি করিতে লাগিলেন । পাহারাওয়ালা আসিল ও পণ্ডিতমহাশয়কে ঘিরিয়া দশ সহস্ৰ লোক জমা হইল। বাবু কহিলেন, এই লোকটি তাহার পকেট হইতে টাকা তুলিয়া লইয়াছে। পণ্ডিতমহাশয় ভয়ে আকুল হইলেন ও কঁদো-কঁদো স্বরে কহিলেন, “না। বাবা, আমি লই নাই। তবে তোমার ভ্ৰম হইয়া থাকিবে, আর কেহ লইয়া থাকিবে ।” 'চাের চাের বলিয়া একটা ভারি কলরব-উঠিল, চারি দিকে কতকগুলা ছোড়া জমিল, কেহ তাহার টিকি ধরিয়া টানিতে লাগিল, কেহ তাহাকে চিমটি কাটিতে লাগিল— পণ্ডিতমহাশয় থতমত খাইয়া কঁাদিয়া ফেলিলেন। র্তাহার ট্যাকে যত টাকা ছিল সমস্ত লইয়া বাবুটকে কহিলেন, “বাবা, তোমার টাকা হারাইয়া থাকে। যদি, তবে এই লও। আমি ব্ৰাহ্মণের ছেলে, তোমার পায়ে পড়িতেছি— আমাকে शकों कालों ।” ইহাতে তাহার দোষ অধিকতর সপ্ৰমাণ হইল, পাহারাওয়ালা তাহার হাত ধরিল । এমন সময়ে নিধি চােখ মুখ রাঙাইয়া ভিড় ঠেলিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। নিধির এক-সুট