পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S Sbr রবীন্দ্র-রচনাবলী তোড় সামলাইতে গেল, তার পর স্বরূপ অতি মধুর গদগদ স্বরে কহিলেন, “করুণা।” করুণা এই সম্বোধন শুনিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিল, পথিকের দিকে চাহিল, দেখিল স্বরূপবাবু! তাহার চেয়ে একটা সাপ যদি দেখিত করুণা কম ভয় পাইত । করুণা কিছুই উত্তর দিল না। স্বরূপ অনেক কথা বলিতে লাগিল, এ কয় রাত্রি সে করুণার জন্যে কত কষ্ট পাইয়াছিল তাহার সমস্ত বর্ণনা করিল। সেই সুখরাত্রে তাঁহাদের প্রেমালাপের যখন সবে সূত্রপাত হইয়াছিল, এমন সময়ে ভঙ্গ হওয়াতে অনেক দুঃখ করিল। সে অতি হতভাগ্য, বিধাতা তাহাকে চিরজীবন দুঃখী করিবার জন্য বুঝি সৃষ্টি করিয়াছেন- তাহার কোনো আশাই সফল হয় না। অবশেষে, করুণা নরেন্দ্রের বাড়ি হইতে যে বাহির হইয়া আসিয়াছে, ইহা লইয়া, অনেক আনন্দ প্রকাশ করিল। কহিল— আরো ভালেই হইয়াছে, তাহাদের দুইজনের যে প্ৰেম, যে স্বগীয় প্ৰেম, তাহা নিষ্কণ্টকে ভোগ করিতে পরিবে । আরো এমন অনেক কথা বলিল, তাহা যদি লিখিয়া লওয়া যাইত তাহা হইলে অনেক বড়ো বড়ো নভেলের রাজপুত ক্ষত্ৰিয় বা অন্যান্য মহা মহা নায়কের মুখে স্বচ্ছন্দে বসানো যাইত । কিন্তু করুণা তাহার রসাস্বাদন করিতে পারে নাই । স্বরূপ এলাহাবাদে যাইবে, তাই স্টেশনে যাইতেছিল। পথের মধ্যে এই সকল ঘটনা । স্বরূপ প্ৰস্তাব করিল করুণা তাহার সঙ্গে পশ্চিমে চলুক, তাহা হইলে আর কোনো ভাবনা ভাবিতে হবে না। করুণা কাল রাত্ৰি হইতে ভাবিতেছিল। কোথায় যাইবে, কী করবে। কিছুই ভাবিয়া পায় নাই। আজিকার দিন তো প্ৰায় যায়-যায়- রাত্রি আসিবে, তখন কী করিবে, কত প্রকার লোক পথ দিয়া যাওয়া-আসা করিতেছে, এই সকল নানান ভাবনার সময় এ প্রস্তাবটা করুণার মন্দ লাগিল না । ছেলেবেলা হইতে যে চিরকাল গৃহের বাহিরে কখনো যায় নাই, সে এই অনাবৃত পৃথিবীর দৃষ্টি কী করিয়া সহিবে বলে । সে একটা আশ্রয় পাইলে, লোকের চোখের আড়াল হইতে পারিলে বঁাচে । তার মনে হইতেছে, যেন সকলেই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে। তাহা ছাড়া করুণা এমন শ্ৰান্ত কাতর হইয়া পড়িয়াছে যে আর সে সহিতে পারে না । একবার মনে করিল স্বরূপের প্রস্তাবে সায় দিয়া যাইবে । কিন্তু স্বরূপের উপর তাহার এমন একটা ভয় আছে যে পা আর উঠিতে চায় না । করুণা ভাবিল, “এই গাছের তলায় নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িয়া থাকি, না খাইয়া না দাইয়া মরিয়া যাইব ।” কিন্তু রক্তমাংসের শরীরে কত সহিবে বলো- এ ভাবনা আর বেশিক্ষণ স্থান পাইল না । স্বরূপের প্রস্তাবে সম্মত হইল । সন্ধ্যা হইল । করুণা ও স্বরূপ এখন ট্রেনের মধ্যে । বিংশ পরিচ্ছেদ স্বরূপ ও করুণা কাশীতে আছে। করুণার দুরবস্থা বলিবার নহে। সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকিয়া সে যে কী অবস্থায় দিন যাপন করিতেছে তাহা সেই জানে। স্বরূপের ভ্রম অনেক দিন হইল ভাঙিয়াছে, এখন বুঝিয়াছে করুণা তাহাকে ভালোবাসে না । সে ভাবিতেছে “একি উৎপাত ! এত করিয়া আনিলাম, গাড়িভাড়া দিলাম— সকলই ব্যর্থ হইল!” সে যে বিরক্ত হইয়াছে তাহা আর বলিবার নহে। সে মনে করিয়াছিল এতদিন কবিতায় যাহা লিখিয়া আসিয়াছে, কল্পনায় চিত্র করিয়াছে, আজ সেই প্রেমের সুখ, উপভোগ করিবে । কিন্তু সে কাছে আসিলে করুণা ভয়ে জড়োসড়ো আড়ষ্ট হইয়া মরিয়া যায়, তাহার সঙ্গে কথাই কহে না। স্বরূপ ভাবিল, “একি উৎপাত ! এ গলগ্ৰহ বিদায় করিতে পারিলে যে বীচি।” ভাবিল দিন-কতক কাছে থাকিতে থাকিতেই ভালোবাসা হইবে । স্বরূপ তো তাহার যথাসাধ্য করিল, কিন্তু করুণার ভালোবাসার কোনো চিহ্ন দেখিল না । করুণা বেচারির তো আরাম বিশ্রাম নাই। এক তো সর্বক্ষণ পরের বাড়িতে অচেনা পুরুষের সঙ্গে আছে বলিয়া সর্বদাই আত্মগ্নানিতে দগ্ধ হইতেছে। তাহা ছাড়া স্বরূপের ভাব-গতিক দেখিয়া সে তো ভয়ে আকুল- সে কাছে বসিয়া গান গায়, কবিতা শুনাইতে থাকে, মনের দুঃখ নিবেদন করে,