পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ֆ Հ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী রজনী মহেন্দ্ৰকে দেখিয়া মহা শশব্যস্ত হইয়া পড়িল, কেমন অপ্ৰস্তুত হইয়া গেল। সে মনে করিতে লাগিল, মহেন্দ্ৰ তাহাকে দেখিয়া কি বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছে ! তাহার তাড়াতাড়ি বলিবার ইচ্ছা হইল যে, “আমি এখনই যাইতেছি, আমার সমস্তই প্ৰস্তুত হইয়াছে।” যখন সে এই গোলমালে পড়িয়া কী করিবে: ভাবিয়া পাইতেছে না, তখন মহেন্দ্ৰ ধীরে ধীরে তাহার পার্থে গিয়া বসিল । কী ভাগ্য ! বিষগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি নাকি আজই দিদির বাড়ি যাবে। কেন রজনী।” আর কি উত্তর দিবার জো আছে।- “আমি তোমার কাছে অনেক অপরাধ করিয়াছি, আমি তোমাকে কষ্ট দিয়াছি, কিন্তু তাহা কি ক্ষমা করিবে না।” ওকি মহেন্দ্ৰ ! অমন করিয়া বলিয়াে না, রজনীর বুক ফাটিয়া যাইতেছে- “বলো, তাহা কি ক্ষমা করিবে না ।” রজনীর উত্তর দিবার কি ক্ষমতা আছে। সে পূর্ণ উচ্ছাসে কাদিয়া উঠিল। মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া বলিল, “একবার বলো ক্ষমা করিলে।” রজনী ভাবিল— সেকি কথা । মহেন্দ্ৰ কেন ক্ষমা চাহিতেছেন । সে জানিত তাহারই সমস্ত দোষ, সেই মহেন্দ্রের নিকট অপরাধী, কেননা তাহার জন্যই মহেন্দ্র এত কষ্ট সহ্য করিয়াছেন, গৃহ ত্যাগ করিয়া কত বৎসর বিদেশে কাল যাপন করিয়াছেন, সে কোথায় মহেন্দ্রের নিকট ক্ষমা চাহিবে- তাহা না হইয়া একি বিপরীত ! ক্ষমা চাহিবে কী, সে নিজেই ক্ষমা চাহিতে সাহস করে নাই। সে কি ক্ষমার যোগ্য। মহেন্দ্র রজনীর দুর্বল মস্তক কোলে তুলিয়া লইল । রজনী ভাবিল, “এই সময়ে যদি মারি তবে কী সুখে মারি ? তাহার কেমন সংকোচ বোধ হইতে লাগিল, মহেন্দ্রের ক্রোড় তাহার নিকট যেন ভিখারির নিকট সিংহাসন । A. মহেন্দ্র তাহাকে কত কী কথা বলিল, সে-সকল কথার উত্তর দিতে পারিল না। সে ভাবিল এ মধুর স্বপ্ন চিরস্থায়ী নহে- এই মুহুর্তে মরিতে পাইলে কী সুখী হই! কিন্তু এ অবস্থা কতক্ষণ রহিবে ।” রজনীর এ সংকোচ শীঘ্ৰ দূর হইল। রজনী তাহার কোলে মাথা রাখিয়া কতক্ষণ কত কী কথা কহিল- কত অশ্রুজল, কত কথা, কত হাসি, সে বলিবার নহে। মহেন্দ্র যখন উঠিয়া যাইতে চাহিল তখন রজনী তাহাকে আর-একটু বসিয়া থাকিতে অনুরোধ করিল, যাহা আর কখনো করিতে সাহস করে নাই। রজনীর একি পরিবর্তন ! যে সুখ সে কখনো আশা করে নাই, আপনাকে যে সুখ পাইবার যোগ্য বলিয়া মনে করে নাই, সেই সুখ সহসা পাইয়াছে— আহলাদে তাহার বুক ফাটিয়া যাইতেছিল- সে কী করিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না। সেই সন্ধ্যাবেলাই সে মোহিনীর বাড়িতে গেল, তাড়াতাড়ি তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাদিতে বসিল । মোহিনী জিজ্ঞাসা করিল, “কেন রজনী, কী হয়েছে।” সে মনে করিল মহেন্দ্ৰ না জানি আবার কী অন্যায়ীচরণ করিয়াছে। রজনী তাহাকে সকল কথা বলিতে লাগিল— শুনিয়া মোহিনীও আহলাদে কাদিতে লাগিল । রজনীর দুই-এক মাসের মধ্যে যে কোনাে ব্যাধি বা দুর্বলতা হইয়াছিল তাহার কোনাে চিহ্ন পাওয়া গেল না । আর কখনো রজনীর ঘরকন্নার কাজে এত উৎসাহ কেহ দেখে নাই- শাশুড়ি মহা উগ্রভাবে কহিলেন, “হয়েছে, হয়েছে, ঢের হয়েছে, আর গিন্নিপনা করে কােজ নেই, দুদিন উপোস করে আছেন, সবে আজ ভাত খেয়েছেন, ওঁর গিন্নিপন দেখে আর বঁচি নে ৷” এইখানে একটা কথা বলা আবশ্যক- রজনী যে দুদিন উপোস করিয়াছিল সে দুদিন কাজ করিতে পারে নি বলিয়া তাহার শাশুড়ি মহা বক্তৃতা দিয়াছিলেন ও ভবিষ্যতে যখনই রজনীর দোষের অভাব পড়িবে সেই দুই দিনের কথা লইয়া আবার বক্তৃতা যে দিবেন। ইহাও নিশ্চিত, এ বিষয়ে কোনো পাঠকের সন্দেহ উপস্থিত না হয় । দেখিতে দেখিতে করুণার সহিত রজনীর মহা ভাব হইয়া গেল। দুইজনের ফুসফুস করিয়া মহা মনের কথা পড়িয়া গেল- তাহদের কথা আর ফুরায় না। তাহাদের স্বামীদের কত দিনকার সামান্য