পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মপরিচয় S8& মানুষ-আকারে বদ্ধ যে জন ঘরে, যাহারে কঁপায় স্তুতিনিন্দার জ্বরে, কবিরে খুজিছ তাহারি জীবনচরিতে ? Σ\ΟΣ Σ NR অকালে যাহার উদয় তাহার সম্বন্ধে মনের আশঙ্কা ঘুচিতে চায় না। আপনাদের কাছ হইতে আমি যে সমাদর লাভ করিয়াছি সে একটি অকালের ফল- এইজন্য ভয় হয়। কখন সে বৃন্তচু্যুত হইয়া পড়ে । অন্যান্য সেবকদের মতো সাহিত্যসেবক কবিদেরও খোরাকি এবং বেতন এই দুই রকমের প্রাপ্য আছে । তারা প্রতিদিনের ক্ষুধা মিটাইবার মতো কিছু কিছু যশের খোরাকি প্রত্যাশা করিয়া থাকেননিতান্তই উপবাসে দিন চলে না । কিন্তু এমন কবিও আছেন তাহাদের আপ-খোরাকি বন্দোবস্ত মুড়িমুড়কিও দেয় না। এই তো গেল দিনের খোরাক- ইহা দিন গেলে জোটে এবং দিনের সঙ্গে ইহার ক্ষয় হয় । তার পরে বেতন আছে। কিন্তু সে তো মাস না গেলে দাবি করা যায় না । সেই চিরদিনের প্রাপ্যাটা, বাচিয়া থাকিতেই আদায় করিবার রীতি নাই। এই বেতনটার হিসাব চিত্রগুপ্তের খাতাঞ্চিখানাতেই হইয়া থাকে। সেখানে হিসাবের ভুল প্রায় হয় না। কিন্তু বাচিয়া থাকিতেই যদি আগাম শোধের বন্দোবস্ত হয় তবে সেটাতে বড়ো সন্দেহ জন্মায়। সংসারে অনেক জিনিস ফাকি দিয়া পাইয়াও সেটা রক্ষা করা চলে। অনেকে পরকে ফাকি দিয়া ধনী হইয়াছে এমন দৃষ্টান্ত একেবারে দেখা যায় না। তাহা নহে। কিন্তু যশ জিনিসটাতে সে সুবিধা নাই। উহার সম্বন্ধে তােমাদির আইন খাটে না । যেদিন ফাকি ধরা পড়িবে সেইদিনই ওটি বাজেয়াপ্ত হইবে। মহাকালের এমনি বিধি। অতএব জীবিতকালে কবি যে সম্মানলাভ করিল সেটি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইবার জো নাই । শুধু এই নয়। বীচিয়া থাকিতেই যদি মাহিনা চুকাইয়া লণ্ডয়া হয় তবে সেটা সম্পূর্ণ কবির হাতে গিয়া পড়ে না। কবির বাহির-দরজায় একটা মানুষ দিনরাত আড্ডা করিয়া থাকে, সে দালালি আদায় করিয়া লয় । কবি যতবড়ো কবিই হউক, তাহার সমস্তটাই কবি নয় । তাহার-সঙ্গে সঙ্গে যে-একটি অহং লাগিয়া থাকে, সকল-তাতেই সে আপনার ভাগ বসাইতে চায় ! তাহার বিশ্বাস, কৃতিত্ব সমস্ত তাহারই এবং কবিত্বের গৌরব তাঁহারই প্ৰাপ্য। এই বলিয়া সে থলি ভর্তি করিতে থাকে। এমনি করিয়া পূজার নৈবেদ্য পুরুত চুরি করে। কিন্তু মৃত্যুর পরে ঐ অহং-পুরুষটার বালাই থাকে না, তাই পাওনাট নিরাপদে যথাস্থানে গিয়া পেঁৗছে। : অহংটাই পৃথিবীর মধ্যে সকলের চেয়ে বড়ো চোর। সে স্বয়ং ভগবানের সামগ্ৰীও নিজের বলিয়া দাবি করিতে কুষ্ঠিত হয় না। এইজন্যই তো ঐ দুৰ্বত্তটাকে দাবাইয়া রাখিবার জন্য এত অনুশাসন। “এইজন্যই তো মনু বলিয়াছেন- সম্মানকে বিষের মতো জানিবে, অপমােনই অমৃত । সুন্মান যেখানেই লোভনীয় সেখানেই সাধ্যমত তাহার সংস্রব পরিহার করা ভালো । আমার তাে বয়স পঞ্চাশ পার হইল। এখন বনে যাইবার ডাক পড়িয়াছে। এখন ত্যাগেরই দিন। এখন নূতন সঞ্চায়ের বোঝা মাথায় করিলে তো কাজ চলিবে না। অতএব এই পঞ্চাশের পরেও ঈশ্বর যদি আমাকে সম্মান জুটাইয়া দেন। তবে নিশ্চয় বুঝিব, লে কেবল ত্যাগ-শিক্ষারই জন্য। এ সম্মানকে আমি আপনার বলিয়া গ্ৰহণ করিতে পারিব না। এই মাথার বোঝা আমাকে সেইখানেই নামাইতে