পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মপরিচয় Y G?) ঘোষিতে দেন না। তাহারা যাহা-কিছু প্ৰকাশ করেন তাহা সমস্তটাই একেবারে সার্থক হইয়া উঠে। আমি জানি, আমার রচনার মধ্যে সেই নিরতিশয় প্রাচুর্য আছে যাহা বহুপরিমাণে ব্যর্থতা বহন করে। অমরত্বের তরণীতে স্থান বেশি নাই, এইজন্য বোঝাকে যতই সংহত করিতে পারিব বিনাশের পারের ঘাটে পৌঁছিবার সম্ভাবনা ততই বেশি হইবে । মহাকালের হাতে আমরা যত বেশি দিব ততই বেশি সে লাইবে ইহা সত্য নহে। আমার বোঝা অত্যন্ত ভারী হইয়াছে- ইহা হইতেই বুঝা যাইতেছে ইহার মধ্যে অনেকটা অংশে মৃত্যুর মার্কা পডিয়াছে। যিনি অমরত্বরথের রখী। তিনি সোনার মুকুট, হীরার কঠি, মানিকের অঙ্গদ ধারণ করেন, তিনি বস্তা মাথায় করিয়া লন না । কিন্তু আমি কারুকরের মতো সংহত অথচ মূল্যবান গহনা গড়িয়া দিতে পারি নাই। আমি, যখন যাহা জুটিয়াছে তাহা লইয়া কেবল মোট বাধিয়া দিয়াছি ; তাহার দামের চেয়ে তাহার ভার বেশি। অপব্যয় বলিয়া যেমন একটা ব্যাপার আছে অপসঞ্চয়ও তেমনি একটি উৎপাত । সাহিত্যে এই অপরাধ আমার ঘটিয়াছে। যেখানে মালচালানের পরীক্ষাশালা সেই কস্টমহীেসের হাত হইতে ইহার সমস্তগুলি পার হইতে পারিবে না। কিন্তু সেই লোকসানের আশঙ্কা লইয়া ক্ষোভ করিতে চাই না। যেমন এক দিকে চিরকালটা আছে তেমনি আর-এক দিকে ক্ষণকালটাও আছে । সেই ক্ষণকালের প্রয়োজনে, ক্ষণকালের উৎসবে, এমন-কি, ক্ষণকালের অনাবশ্যক ফেলাছড়ার ব্যাপারেও যাহা জোগান দেওয়া গেছে, তাহার স্থায়িত্ব নাই বলিয়া যে তাহার কোনো ফল নাই তাহা বলিতে পারি না । একটা ফল তো এই দেখিতেছি, অন্তত প্রাচুর্যের দ্বারাতেও বর্তমানকালের হৃদয়টিকে আমার কবিত্বচেষ্টা কিছু পরিমাণে জুড়িয়া বসিয়াছে এবং আমার পাঠকদের হৃদয়ের তরফ হইতে আজ যাহা পাইলাম তাহা যে অনেকটা পরিমাণে সেই দানের প্রতিদান তাহাতে সন্দেহ নাই । কিন্তু এই দানও যেমন ক্ষণস্থায়ী তাহার প্রতিদানও চিরদিনের নহে। আমি যে ফুল ফুটাইয়াছি তাহারও বিস্তর ঝরিবে, আপনারা যে মালা দিলেন তাহারও অনেক শুকাইবে । বাঁচিয়া থাকিতেই কবি যাহা পায় তাহার মধ্যে ক্ষণকালের এই দেনাপাওনা শোধ হইতে থাকে । আদ্যকার সম্বর্ধনার মধ্যে সেই ক্ষণকালের হিসাবনিকাশের অঙ্ক যে প্রচুরপরিমাণে আছে তাহা আমি নিজেকে ভুলিতে দিব না। এই ক্ষণকালের ব্যবসায়ে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় অনেক ফাকি চলে। বিস্তর ব্যর্থতা দিয়া ওজন ভারী করিয়া তোলা যায়-- যতটা মনে করা যায় তাহার চেয়ে বলা যায় বেশি— দর অপেক্ষা দস্তুরের দিকে বেশি দৃষ্টি পড়ে, অনুভবের চেয়ে অনুকরণের মাত্রা অধিক হইয়া উঠে । আমার সুদীর্ঘকালের সাহিত্য-কারবারে সেইসকল ফাকি জ্ঞানে অজ্ঞানে অনেক জমিয়াছে সে কথা আমাকে স্বীকার করিতেই হইবে । কেবল একটি কথা আজ আমি নিজের পক্ষ হইতে বলিব, সেটি এই যে, সাহিত্যে আজ পর্যন্ত আমি যাহা দিবার যোগ্য মনে করিয়াছি তাহাই দিয়াছি, লোকে যাহা দাবি করিয়াছে তাহাই জোগাইতে চেষ্টা করি নাই। আমি আমার রচনা পাঠকদের মনের মতো করিয়া তুলিবার দিকে চোখ না। রাখিয়া আমার মনের মতো করিয়াই সভায় উপস্থিত করিয়াছি। সভার প্রতি ইহাই যথার্থ সম্মান । কিন্তু এরূপ প্ৰণালীতে আর যাহাই হউক, শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত বাহবা পাওয়া যায় না, আমি তাহা পাইও নাই । আমার যশের ভোজে আজ সমাপনের বেলায় যে মধুর জুটিয়াছে, বরাবর এ রসের আয়োজন ছিল না । যে ছন্দে যে ভাষায় একদিন কাব্যরচনা আরম্ভ করিয়াছিলাম তখনকার কালে তাহা আদর পায় । নাই এবং এখনকার কালেও যে তাহা আদরের যোগ্য তাহা আমি বলিতে চাই না । কেবল আমার বলিবার কথা এই যে, যাহা আমার তাঁহাই আমি অন্যকে দিয়াছিলাম- ইহার চেয়ে সহজ সুবিধার পথ আমি অবলম্বন করি নাই। অনেক সময়ে লোককে বঞ্চনা করিয়াই খুশি করা যায়- কিন্তু সেই খুশিও কিছুকাল পরে ফিরিয়া বঞ্চনা করে- সেই সুলভ খুশির দিকে লোভদৃষ্টিপাত করি নাই। তাহার পরে আমার রচনায় অপ্ৰিয় বাক্যও আমি অনেক বলিয়াছি এবং অপ্রিয় বাক্যের যাহা নগদ-বিদায় তাহাও আমাকে বার বার পিঠ পাতিয়া লইতে হইয়াছে। আপনার শক্তিতেই মানুষ আপনার সত্য উন্নতি করিতে পারে, মাগিয়া পাতিয়া কেহ কোনোদিন স্থায়ী কল্যাণ লাভ করিতে পারে