পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মপরিচয় ४१७ পাতলা জামা গায়ে দিয়ে বুকের কাছে দুই হাত চেপে ধরে শীতকে উপেক্ষা করে ছুটে যৌতুম। উত্তর । দিকে টেকিশালের গায়ে ছিল একটা পুরোনাে বিলিতি আমড়ার গাছ, অন্য কোণে ছিল কুলগাছ জীর্ণ পাতকুয়াের ধারে— কুপথ্যলোলুপ মেয়েরা দুপুরবেলায় তার তলায় ভিড় করত। মাঝখানে ছিল। পূর্বযুগের দীর্ণ ফাটলের রেখা নিয়ে শেওলায়-চিহ্নিত শান-বাঁধানাে চানকা। আর ছিল অযত্নে উপেক্ষিত অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, নাম করবার যোগ্য আর-কোনো গাছের কথা মনে পড়ে না। এই তো আমার বাগান, এই ছিল আমার যথেষ্ট। এইখানে যেন ভাঙা-কানা-ওয়ালা পাত্র থেকে আমি । পেতুম পিপাসার জল। সে জল লুকিয়ে ঢেলে দিত। আমার ভিতরকার এক দরদী। বস্তু যা পেয়েছি তার চেয়ে রস পেয়েছি অনেক বেশি । আজ বুঝতে পারি। এজন্যেই আমার আসা। আমি সাধু নই, সাধক নই, বিশ্বরচনার অমৃত-স্বাদের আমি যাচনদার, বার বার বলতে এসেছি "ভালো লাগল আমার । বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে এসে গাড়ি থেকে নামবামাত্র পুবের দিকে তাকিয়ে দেখেছি। তেতলার ছাদের উপরকার আকাশে নিবিড় হয়ে ঘনিয়ে এসেছে ঘননীলবৰ্ণ মেঘের পুঞ্জ। মুহুর্তমাত্রে সেই মেঘপুঞ্জের চেয়ে ঘনতর বিস্ময় আমার মনে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে। এক দিকে দূরে মেঘমেদুর আকাশ, অন্য দিকে ভূতলে-নতুন-আসা বালকের মন বিস্ময়ে আনন্দিত । এই আশ্চর্য মিল ঘটাবার প্রয়ােজন ছিল, নইলে ছন্দ মেলে না। জগতে কাজ করবার লোকের ডাক পড়ে, চেয়ে দেখার লোকেরও আহবান আছে। আমার মধ্যে এই চেয়ে-দেখার ঔৎসুক্যকে নিত্য পূর্ণ করবার আবেগ আমি অনুভব করেছি। এ দেখা তো নিক্রিয় আলস্যপরতা নয়। এই দেখা এবং দেখানোর তালে তালেই সৃষ্টি । ঋগবেদে একটি আশ্চর্য বচন আছেঅভ্রাতৃব্যো অনাত্বমন্যুপিরিন্দ্র জনুষ সনদসি। যুদ্ধেদাপিত্বমিচ্ছাসে। হে ইন্দ্ৰ, তোমার শত্রু নেই, তোমার নায়ক নেই, তোমার বন্ধু নেই, তবু প্রকাশ হবার কালে যোগের দ্বারা বন্ধুত্ব ইচ্ছা কর । যতবড়ো ক্ষমতাশালী হােন-না কেন সত্যভাবে প্রকাশ পেতে হলে বন্ধুতা চাই, আপনাকে ভালো লাগানো চাই। ভালো লাগাবার জন্য নিখিল বিশ্বে তাই তো এত অসংখ্য আয়োজন । তাই তো শব্দের থেকে গান জাগছে, রেখার থেকে রূপের অপরূপতা । সে যে কী আশ্চর্য সে আমরা ভুলে থাকি । এ কথা বলব, সৃষ্টিতে আমার ডাক পড়েছে, এইখানেই, এই সংসারের অনাবশ্যক মহলে। ইন্দ্রের সঙ্গে আমি যোগ ঘটাতে এসেছি যে যোগ বন্ধুত্বের যোগ । জীবনের প্রয়োজন আছে অন্নে বস্ত্রে বাসস্থানে, প্রয়োজন নেই আনন্দরূপে অমৃতরূপে। সেইখানে জায়গা নেয় ইন্দ্রের সখারা। অন্তি সন্তং ন জহাতি অন্তি সন্তং ন পশ্যতি । দোবস্য পশ্য কাব্যং নামমােরন জীৰ্যতি।। কাছে আছেন তাকে ছাড়া যায় না, কাছে আছেন তাকে দেখা যায় না, কিন্তু দেখো সেই দেবের কাব্য ; সে কাব্য মরে না, জীর্ণ হয় না । জন্তুদের উপর সৃষ্টিকর্তার ক্রিয়া অব্যবহিত। তার থেকে তারা সরে এসে তাকে দেখতে পায় না। কেবলমাত্র নিয়মের সম্বন্ধে মানুষের সঙ্গে তার যদি সম্বন্ধ হত তা হলে সেই জন্তুদের মতোই কেবল অপরিহার্য ঘটনার ধারার দ্বারা বেষ্টিত হয়ে মানুষ তাকে পেত না । কিন্তু দেবতার কাব্যে নিয়মজালের ভিতর থেকেই নিয়মের অতীত যিনি তিনি আবির্ভূত। সেই কাব্যে কেবলমাত্র আছে তার বিশুদ্ধ थकम् । এই প্রকাশের কথায় ঋষি বলেছেন অবির বৈ নাম দেবতার তেনান্তে পরীবৃতা। তস্যারূপেণ্যেমে বৃক্ষা হরিত হরিতন্ত্ৰজঃ।।