পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের স্বরূপ সাহিত্যের স্বরূপ কবিতা ব্যাপারটা কী, এই নিয়ে দু-চার কথা বলবার জন্যে ফর্মােশ এসেছে। সাহিত্যের স্বরূপ সম্বন্ধে বিচার পূর্বেই কোথাও কোথাও করেছি। সেটা অন্তরের উপলব্ধি থেকে ; বাইরের অভিজ্ঞতা বা বিশ্লেষণ থেকে নয়। কবিতা জিনিসটা ভিতরের একটা তাগিদ, কিসের তাগিদ। সেই কথাটাই নিজেকে প্রশ্ন করেছি। যা উত্তর পেয়েছি সেটাকে সহজ করে বলা সহজ নয় । ওস্তাদমহলে এই বিষয়টা নিয়ে যে-সব বাধা বচন জমা হয়ে উঠেছে, কথা উঠলেই সেইগুলোই এগিয়ে আসতে চায় ; নিজের উপলব্ধ অভিমতকে পথ দিতে গেলে ঐগুলোকে ঠেকিয়ে রাখা দরকার। গোড়াতেই গোলমাল ঠেকায় "সুন্দর' কথাটা নিয়ে। সুন্দরের বোধকেই বোধগম্য করা কাব্যের উদ্দেশ্য এ কথা কোনো উপাচার্য আওড়াবামাত্র অভ্যস্ত নির্বিচারে বলতে ঝোক হয়, তা তো বটেই। প্রমাণ সংগ্ৰহ করতে গিয়ে ধোক লাগায়, ভাবতে বসি সুন্দর বলে কাকে । কনে দেখবার বেলায় বরের অভিভাবক যে আদর্শ নিয়ে কনেকে দাঁড় করিয়ে দেখে, হাঁটিয়ে দেখে, চুল খুলিয়ে দেখে, কথা কইয়ে দেখে, সে আদর্শ কাব্য যাচাইয়ের কাজে লাগাতে গেলে পদে পদেই বাধা পাওয়া যায়। দেখতে পাই, ফলস্টাফের সঙ্গে কন্দৰ্পের তুলনা হয় না, অথচ সাহিত্যের চিত্ৰভাণ্ডার থেকে কন্দৰ্পক বাদ দিলে লোকসান নেই, লোকসান আছে। ফলস্টাফকে বাদ দিলে। দেখা গেল, সীতার চরিত্র রামায়ণে মহিমান্বিত বটে, কিন্তু স্বয়ং বীর হনুমন- তার যত বড়ো লাঙ্গুল তত বড়োই সে মর্যাদা পেয়েছে। এইরকম সংশয়ের সময়ে কবির বাণী মনে পড়ে, Truth is beauty, অৰ্থাৎ সত্যই সৌন্দর্য। কিন্তু সত্যে তখনই সৌন্দর্যের রস পাই, অন্তরের মধ্যে যখন পাই তার নিবিড় উপলব্ধি- জ্ঞানে নয়, স্বীকৃতিতে। তাকেই বলি বাস্তব। সর্বগুণাধার যুধিষ্ঠিরের চেয়ে হঠকারী ভীম বাস্তব, রামচন্দ্র যিনি শাস্ত্রের বিধি মেনে ঠাণ্ডা হয়ে থাকেন তার চেয়ে লক্ষ্মণ বাস্তব- যিনি অন্যায় সহ্য করতে না পেরে অগ্নিশৰ্মা হয়ে তার অশাস্ত্রীয় প্রতিকার করতে উদ্যত। আমাদের কালো-কালো আধাবুড়ো নীলমণি চাকরাটা, যে মানুষ এক বুঝতে আর বোঝে, এক করতে আর করে, বকলে ঈষৎ হেসে বলে “ভুল হয়ে গেছে, সে বেনারসি-জোড় পরে বরবেশে এলে দৃশ্যটা কিরকম হয় সে কথা তুচ্ছ, কিন্তু সে অনেক বেশি বাস্তব অনেক নামজাদার চেয়ে এই প্রসঙ্গে তাদের নাম উল্লেখ করতে কুষ্ঠা হচ্ছে। অর্থাৎ, যদি কবিতা লেখা যায়। তবে একে তার নায়ক বা উপন্যায়ক করলে ঢের বেশি উপাদেয় হবে কোনো বাক্ষ্মীপ্রবর গণনায়ককে করার চেয়ে । খুব বেশি চেনা হলেই যে বাস্তব হয় তা নয়, কিন্তু যাকে চিনি অল্প তবু যাকে অপরিহার্যরূপে হাঁ বলেই মানি সেই আমার পক্ষে বাস্তব। ঠিক কী গুণে যে, তা বিশ্লেষণ করে বলা কঠিন। বলা যেতে পারে, তারা জৈব, তারা organic ; তাদের আত্মসাৎ করতে রুচি বা ইচ্ছার বাধা থাকতে পারে, অন্য বাধা নেই। যেমন ভোজ্য পদার্থ, তাদের কোনোটা তিতে, কোনােটা মিষ্টি, কোনােটা কটু ; ব্যবহারে তাদের সম্বন্ধে আদরণীয়তার তারতম্য থাকলেও তাদের সকলেরই মধ্যে একটা সাম্য আছে— তারা জৈবিক, দেহতত্ত্বর নির্মাণে তারা কাজে লাগবার উপযোগী। শরীরের পক্ষে তারা ই-এর দলে, স্বীকৃতির দলে, না-এর দলে নয়। সংসারে আমাদের সকলেরই চার দিকে এই ই-ধমীর মণ্ডলী আছে- এই বাস্তবদের আবেষ্টন ; তাদের সকলকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে আমাদের সত্তা আপনাকে বিচিত্র করেছে, বিত্তীর্ণ হয়েছে ;