পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের স্বরূপ Stro ইনটেলেকচুয়েল কসরতের কাজে লেগেছে। তাতে শ্ৰী নেই, তাতে পরিমিতি নেই, তাতে রূপ নেই, আছে প্রচুর বাক্যের পিণ্ড । অর্থাৎ, এটা দানবিক ওজনের সাহিত্য, মানবিক ওজনের নয় ; বিস্ময়কররূপে ইনটেলেকচুয়েল ; প্রয়োজন-সাধকও হতে পারে, কিন্তু স্বতঃস্ফুর্ত, প্ৰাণবান নয়। পৃথিবীর অতিকায় জন্তুগুলো আপন অস্থিমাংসের বাহুল্য নিয়ে মরেছে, এরাও আপন অতিমিতির দ্বারাই মরছে। প্ৰাণের ধর্ম সুমিতি, আর্টের ধর্মও তাই। এই সুমিতিতেই প্ৰাণের স্বাস্থ্য ও আনন্দ, এই সুমিতিতেই আর্টের শ্ৰী ও সম্পূর্ণতা । লোভ পরিমিতিকে লঙ্ঘন করে, আপন আতিশয্যের সীমা দেখতে পায় না ; লোভ উপকরণবতাং জীবিতং যা তাকেই জীবিত বলে, অমৃতকে বলে না। উপকরণের বাহাদুরি তার বহুলতায়, অমৃতের সার্থকতা তার অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্যে। আর্টেরও অমৃত আপন সুপরিমিত সামঞ্জস্যে। তার হঠাৎ-নবাবি আপন ইনটেলেকচুয়েল অত্যাড়ম্বরে ; সেটা যথার্থ আভিজাত্য নয়, সেটা স্বল্পায়ু মরণধমী । মেঘদূত কাব্যটি প্রাণবান, আপনার মধ্যে ওর সামঞ্জস্য । সুপরিমিত । ওর মধ্যে থেকে একটা তত্ত্ব বের করা যেতে পারে, আমিও এমন কাজ করেছি, কিন্তু সে তত্ত্ব অদৃশ্যভাবে গীেণ। রঘুবংশকাব্যে কালিদাস স্পষ্টই আপন উদ্দেশ্যের কথা ভূমিকায় স্বীকার করেছেন। রাজধর্মের কিসে গৌরব, কিসে তার পতন, কবিতায় এইটের তিনি দৃষ্টান্ত দিতে চেয়েছেন। এইজন্য সমগ্রভাবে দেখতে গেলে রঘুবংশকাব্য আপন ভারবাহুল্যে অভিভূত, মেঘদূতের মতো তাতে রূপের সম্পূর্ণতা নেই। কাব্য হিসাবে কুমারসম্ভবের যেখানে থামা উচিত। সেখানেই ও থেমে গেছে, কিন্তু লজিক হিসাবে প্রবলেম হিসাবে ওখানে থামা চলে না । কার্তিক জন্মগ্রহণের পরে স্বৰ্গ উদ্ধার করলে তবেই প্রবলেমের শান্তি হয়। কিন্তু আর্টে দরকার নেই প্রবলেমকে ঠাণ্ডা করা, নিজের রূপটিকে সম্পূর্ণ করাই তার কাজ। প্রবলেমের গ্ৰন্থি-মোচন ইনটেলেকটের বাহাদুরি, কিন্তু রূপকে সম্পূর্ণতা দেওয়া সৃষ্টিশক্তিমতী কল্পনার কাজ। আর্ট এই কল্পনার এলেকায় থাকে, লজিকের এলেকায় নয় । তোমার চিঠিতে তুমি আমার লেখা গোরা ঘরে-বাইরে প্রভৃতি নভেলের উল্লেখ করেছ। নিজের লেখার সমালোচনা করবার অধিকার নেই, তাই বিস্তারিত করে কিছু বলতে পারব না। আমার এই দুটি নভেলে মনস্তত্ত্ব রাষ্ট্রতত্ত্ব প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ের আলোচনা আছে সে কথা কবুল করতেই হবে। সাহিত্যের তরফ থেকে বিচার করতে হলে দেখা চাই যে, সেগুলি জায়গা পেয়েছে না জায়গা জুড়েছে । আহার্য জিনিস অস্তরে নিয়ে হজম করলে দেহের সঙ্গে তার প্রাণগত ঐক্য ঘটে । কিন্তু বুড়িতে করে যদি মাথায় বহন করা যায়। তবে তাতে বাহ্য প্রয়ােজন সাধন হতে পারে, কিন্তু প্রাণের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য হয় না । গোরা-গল্পে তর্কের বিষয় যদি বুড়িতে করে রাখা হয়ে থাকে। তবে সেই বিষয়গুলির দাম যতই হােক-না, সে নিন্দনীয়। আলোচনার সামগ্ৰীগুলি গোরা ও বিনয়ের একান্ত চরিত্রগত প্ৰাণগত উপাদান যদি না হয়ে থাকে। তবে প্রবলেমে ও প্রাণে, প্রবন্ধে ও গল্পে, জোড়াতাড়া জিনিস সাহিত্যে বেশিদিন টিকবে না। প্রথমত আলোচ্য তত্ত্ববস্তুর মূল্য দেখতে দেখতে কমে আসে, তার পরে সে যদি গল্পটাকে জীৰ্ণ করে ফেলে তা হলে সবসুদ্ধ জড়িয়ে সে আবৰ্জনারাপে সাহিত্যের আঁস্তাকুড়ে জমে ওঠে । ইবসেনের নাটকগুলি তো একদিন কম আদর পায় নি, কিন্তু এখনই কি তার রঙ ফিকে হয়ে আসে নি। কিছুকাল পরে সে কি আর চােখে পড়বে। মানুষের প্রাণের কথা চিরকালের আনন্দের জিনিস ; বুদ্ধিবিচারের কথা বিশেষ দেশকালে যত নতুন হয়েই দেখা দিক, দেখতে দেখতে তার দিন ফুরোয়। তখনো সাহিত্য যদি তাকে ধরে রাখে তা হলে মৃতের বাহন হয়ে তার দুৰ্গতি ঘটে । প্ৰাণ কিছু পরিমাণে অপ্রাণকে বহন করেই থাকে- যেমন আমাদের বসন, আমাদের ভূষণ, কিন্তু প্ৰাণের সঙ্গে রফা করে চলবার জন্যে তার ওজন প্রাণকে যেন ছড়িয়ে না যায়। য়ুরোপে অপ্ৰাণের বোঝা প্ৰাণের উপর চেপেছে অতিপরিমাণে ; সেটা সইবে না । তার সাহিত্যেও সেই দশা । আপন প্রবল গতিবেগে যুরোপ এই প্রভূত বোঝা আজও বইতে পারছে, কিন্তু বোঝার চাপে এই গতির বেগ ক্রমশ কমে আসবে তাতে সন্দেহ নেই। অসংগত অপরিমিত প্ৰকাণ্ডত প্ৰাণের কাছ থেকে এত বেশি মাশুল আদায় করতে থাকে যে, একদিন তাকে দেউলে করে দেয়। SK 908 o