পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের স্বরূপ : እobr፭s চলে এক্রমাগতই বেড়া ডিঙিয়ে । অর্থাৎ এর ভঙ্গি পদ্যের মতো কিন্তু ব্যবহার গদ্যের চালে । সংস্কারে অনিত্যতার আর-একটা প্রমাণ দিই। এক সময়ে কুলবধুর সংজ্ঞা ছিল, সে অন্তঃপুরচারিণী। প্রথম যে কুলস্ত্রীরা অন্তঃপুর থেকে অসংকোচে বেরিয়ে এলেন তঁরা সাধারণের সংস্কারকে আঘাত করাতে তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখা ও অপ্রকাশ্যে বা প্ৰকাশ্যে অপমানিত করা, প্রহসনের নায়িকারূপে তাদেরকে অট্টহাস্যের বিষয় করা, প্রচলিত হয়ে এসেছিল । সেদিন যে মেয়েরা সাহস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরুষছাত্রদের সঙ্গে একত্রে পাঠ নিতেন তাদের সম্বন্ধে কাপুরুষ আচরণের কথা জানা আছে । ক্রমশই সংজ্ঞার পরিবর্তন হয়ে আসছে। কুলস্ত্রীরা আজ অসংশয়িতভাবে কুলস্ত্রীই আছেন, যদিও অন্তঃপুরের অবরোধ থেকে তঁরা মুক্ত । তেমনি অমিত্ৰাক্ষর ছন্দের মিলবর্জিত অসমানতাকে কেউ কাব্যরীতির বিরোধী বলে আজ মনে করেন না। অথচ পূর্বতন বিধানকে এই ছন্দে বহু দূরে লঙ্ঘন করে গেছে। কাজটা সহজ হয়েছিল, কেননা তখনকার ইংরেজি-শেখা পাঠকেরা মিলটন-শেকসপীয়রের ছন্দকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হয়েছিলেন । অমিত্ৰাক্ষর ছন্দকে জাতে তুলে নেবার প্রসঙ্গে সাহিত্যিক সনাতনীরা এই কথা বলবেন যে, যদিও এই ছন্দ চৌদ্দ অক্ষরের গণ্ডিটা পেরিয়ে চলে। তবু সে পয়ারের লয়টাকে অমান্য করে না । অর্থাৎ, লিয়কে রক্ষা করার দ্বারা এই ছন্দ কাব্যের ধর্ম রক্ষা করেছে, অমিত্ৰাক্ষর সম্বন্ধে এইটুকু বিশ্বাস লোকে আঁকড়ে রয়েছে। তারা বলতে চায়, পয়ারের সঙ্গে এই নাড়ির সম্বন্ধটুকু না থাকলে কাব্য কাব্যই হতে পারে না । কী হতে পারে এবং হতে পারে না তা হওয়ার উপরেই নির্ভর করে, লোকের অভ্যাসের উপর করে না- এ কথাটা অমিত্ৰাক্ষর ছন্দই, পূর্বে প্রমাণ করেছে। আজ গদ্যকাব্যের উপরে প্রমাণের ভার পড়েছে যে, গদ্যেও কার্ব্যের সঞ্চরণ অসাধ্য নয় । অশ্বারোহী সৈন্যও সৈন্য, আবার পদাতিক সৈন্যও সৈন্য- কোনখানে তাদের মূলগত মিল ? যেখানে লড়াই ক’রে জেতাই তাদের উভয়েরই সাধনার লক্ষ্য । কাব্যের লক্ষ্য হৃদয় জয় করা- পদ্যের ঘোড়ায় চড়েই হােক, আর গদ্যে পা চালিয়েই হােক । সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধির সক্ষমতার দ্বারাই তাকে বিচার করতে হবে। হার হলেই হার, তা সে ঘোড়ায় চড়েই হােক আর পায়ে হেঁটেই হােক। ছন্দে-লেখা রচনা কাব্য হয় নি, তার হাজার প্রমাণ আছে ; গদ্যরচনাও কাব্য নাম ধরলেও কাব্য হবে না, তার ভূরি ভুরি প্রমাণ জুটিতে থাকবে । ছন্দের একটা সুবিধা এই যে, ছন্দের স্বতই একটা মাধুর্য আছে ; আর কিছু না হয় তো সেটাই একটা লাভ । সস্তা সন্দেশে ছানার অংশ নগণ্য হতে পারে। কিন্তু অন্তত চিনিটা পাওয়া যায় । কিন্তু সহজে সন্তুষ্ট নয় এমন একওঁয়ে মানুষ আছে, যারা চিনি দিয়ে আপনাকে ভোলাতে লজ্জা পায় । মন-ভোলানো মালমসলা বাদ দিয়েও কেবলমাত্র খাটি মাল দিয়েই তারা জিতবে, এমনতরো তাদের জিদ । তারা এই কথাই বলতে চায়, আসল কাব্য জিনিসটা একান্তভাবে ছন্দ-অছন্দ নিয়ে নয়, তার গৌরব তার আন্তরিক সার্থকতায়। গদাই হােক, পদ্যই হােক, রচনামাত্রেই একটা স্বাভাবিক ছন্দ থাকে। পদ্যে সেটা সুপ্ৰত্যক্ষ, গদ্যে সেটা অন্তর্নিহিত। সেই নিগুঢ় ছন্দটিকে পীড়ন করলেই কাব্যকে আহত করা হয়। পদ্যছন্দবােধের চর্চা বাধা নিয়মের পথে চলতে পারে। কিন্তু গদ্যছন্দের পরিমাণবোধ মনের মধ্যে যদি সহজে না থাকে। তবে অলংকার-শাস্ত্রের সাহায্যে এর দুৰ্গমতা পার হওয়া যায় না। অথচ অনেকেই মনে রাখেন না যে, যেহেতু গদ্য সহজ, সেই কারণেই গদ্যছন্দ সহজ নয়। সহজের প্রলোভনেই মারাত্মক বিপদ ঘটে, আপনি এসে পড়ে অসাৰ্তকতা। অসতর্কতাই অপমান করে কলালক্ষ্মীকে, আর কলালক্ষ্মী তার শোধ তোলেন অকৃতাৰ্থতা দিয়ে। অসতর্ক লেখকদের হাতে গদ্যকাব্য অবজ্ঞা ও পরিহাসের উপাদান তুপাকার করে তুলবে, এমন আশঙ্কার কারণ আছে। কিন্তু এই সহজ কথাটা বলতেই হবে, যেটা যথার্থ কাব্য সেটা পদ্য হলেও কাব্য, গদ্য হলেও কাব্য ।