পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের স্বরূপ Sidd বাধ্য। আমি অনেকদিন ধরে রসসৃষ্টির সাধনা করেছি, অনেককে হয়তো আনন্দ দিতে পেরেছি, অনেককে হয়তো-বা দিতে পারি নি। তবু এই বিষয়ে আমার বহুদিনের সঞ্চিত যে অভিজ্ঞতা তার দোহাই দিয়ে দুটাে-একটা কথা বলার ; আপনারা তা সম্পূর্ণ মেনে নেবেন, এমন কোনো মাথার দিব্যি নেই। তর্ক এই চলেছে, গদ্যের রূপ নিয়ে কাব্য আত্মরক্ষা করতে পারে কি না। এতদিন যে রূপেতে কাব্যকে দেখা গেছে এবং সে দেখার সঙ্গে আনন্দের যে অনুষঙ্গ, তার ব্যতিক্রম হয়েছে। গদ্যকাব্যে । কেবল প্রসাধনের ব্যত্যয় নয়, স্বরূপেতে তার ব্যাঘাত ঘটেছে। এখন তর্কের বিষয় এই যে, কাব্যের স্বরূপ ছন্দোবদ্ধ সজার পরে একান্ত নির্ভর করে কি না । কেউ মনে করেন, করে ; আমি মনে করি, করে না। অলংকরণের বহিরাবরণ থেকে মুক্ত করে কাব্য সহজে আপনাকে প্রকাশ করতে পারে, এ বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি দৃষ্টান্ত দেব। আপনারা সকলেই অবগত আছেন, জবালাপুত্র সত্যকমের কাহিনী অবলম্বন করে আমি একটি কবিতা রচনা করেছি। ছান্দােগ্য উপনিষদে এই গল্পটি সহজ গদ্যের ভাষায় পড়েছিলাম, তখন তাকে সত্যিকার কাব্য বলে মেনে নিতে একটুও বাধে নি। উপাখ্যানমাত্ৰ— কাব্য-বিচারক একে বাহিরের দিকে তাকিয়ে কাব্যের পর্যায়ে স্থান দিতে অসম্মত হতে পারেন, কারণ এ তো অনুষ্টুভ ত্ৰিষ্টুভ বা মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত হয় নি। আমি বলি, হয় নি বলেই শ্রেষ্ঠ কাব্য হতে পেরেছে, অপর কোনাে আকস্মিক কারণে নয়। এই সত্যকমের গল্পটি যদি ছন্দে বেঁধে রচনা করা হত। তবে হালকা হয়ে যেত । সপ্তদশ শতাব্দীতে নাম-না-জানা কয়েকজন লেখক ইংরেজিতে গ্ৰীক ও হিব্রু বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন । এ কথা মানতেই হবে যে, সলোমনের গান, ডেভিডের গাথা সত্যিকার কাব্য । এই অনুবাদের ভাষার আশ্চর্য শক্তি এদের মধ্যে কাব্যের রস ও রূপকে নিঃসংশয়ে পরিস্ফুট করেছে। এই গানগুলিতে গদ্যছন্দের যে মুক্ত পদক্ষেপ আছে তাকে যদি পদ্যপ্রথার শিকলে বাধা হত। তবে সর্বনাশই ठूऊ । যজুর্বোেদ যে উদাত্ত ছন্দের সাক্ষাৎ আমরা পাই তাকে আমরা পদ্য বলি না, বলি মন্ত্র । আমরা সবাই জানি যে, মন্ত্রের লক্ষ্য হল শব্দের অর্থকে ধ্বনির ভিতর দিয়ে মনের গভীরে নিয়ে যাওয়া । সেখানে সে যে কেবল অর্থবান তা নয়, ধ্বনিমানও বটে । নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, এই গদ্যমান্ত্রের সার্থকতা অনেকে মনের ভিতর অনুভব করেছেন, কারণ তার ধ্বনি থামলেও অনুরণন থামে না। একদা কোনো-এক অসতর্ক মুহূর্তে আমি আমার গীতাঞ্জলি ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করি। সেদিন বিশিষ্ট ইংরেজ সাহিত্যিকেরা আমার অনুবাদকে তঁদের সাহিত্যের অঙ্গস্বরূপ গ্ৰহণ করলেন । এমন-কি, ইংরেজি গীতাঞ্জলিকে উপলক্ষ করে এমন-সব প্রশংসাবাদ করলেন যাকে অত্যুক্তি মনে করে আমি কুষ্ঠিত হয়েছিলাম। আমি বিদেশী, আমার কাব্যে মিল বা ছন্দের কোনাে চিহ্নই ছিল না, তবু যখন তারা তার ভিতর সম্পূর্ণ কাব্যের রস পেলেন তখন সে কথা তাে স্বীকার না করে পারা গেল না। মনে হয়েছিল, ইংরেজি গদ্যে আমার কাব্যের রূপ দেওয়ায় ক্ষতি হয় নি, বরঞ্চ পদ্যে অনুবাদ করলে হয়তো তা ধিককৃত হত, অশ্রদ্ধেয় হত । মনে পড়ে, একবার শ্ৰীমান সত্যেন্দ্ৰকে বলেছিলুম, “ছন্দের রাজা তুমি, অ-ছন্দের শক্তিতে কাব্যের স্রোতকে তার বাধ ভেঙে প্রবাহিত করো দেখি ” সত্যেনের মতো বিচিত্ৰ ছন্দের স্রষ্টা বাংলায় খুব কমই আছে। হয়তো অভ্যাস তার পথে বাধা দিয়েছিল। তাই তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেন নি । আমি স্বয়ং এই কাব্যরচনার চেষ্টা করেছিলুম ‘লিপিকা’য় ; অবশ্য পদ্যের মতো পদ ভেঙে দেখাই নি । "লিপিকা’ লেখার পর বহুদিন আর গদ্যকাব্য লিখি নি। বোধ করি সাহস হয় নি বলেই । কাব্যভাষার একটা ওজন আছে, সংযম আছে ; তাকেই বলে ছন্দ। গদ্যের বাছবিচার নেই, সে চলে বুক ফুলিয়ে। সেইজন্যেই রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি প্রাত্যহিক ব্যাপার প্রাঞ্জল গদ্যে লেখা চলতে পারে। কিন্তু গদ্যকে কাব্যের প্রবর্তনায় শিল্পিত করা যায়। তখন সেই কাব্যের গতিতে এমন-কিছু প্ৰকাশ পায় যা গদ্যের প্রাত্যহিক ব্যবহারের অতীত। গদ্য বলেই এর ভিতরে অতিমাধুৰ্য-অতিলালিত্যের মাদকতা