পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SV) রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু রইল। তার ভাড়দত্ত। মিডসামার নাইট্রস ড্রীম নাট্যের মূল্য কমে যেতে পারে, কিন্তু ফলস্টাফের প্রভাব বরাবর থাকবে অবিচলিত । জীবন মহাশিল্পী। সে যুগে যুগে দেশে দেশাস্তরে মানুষকে নানা বৈচিত্র্যে মূর্তিমান করে তুলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের চেহারা আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে অদৃশ্য, তবুও বহুশত আছে যা প্রত্যক্ষ, ইতিহাসে যা উজ্জ্বল। জীবনের এই সৃষ্টিকার্য যদি সাহিত্যে যথোচিত নৈপুণ্যের সঙ্গে আশ্রয় লাভ করতে পারে তবেই তা অক্ষয় হয়ে থাকে। সেইরকম সাহিত্যই ধন্য- ধন্য ডন কুইকসট, ধন্য রবিনসন ক্রুসো। আমাদের ঘরে ঘরে রয়ে গেছে ; আঁকা পড়ছে, জীবনশিল্পীর রূপরচনা । কোনো-কোনোট ঝাপসা, অসম্পূর্ণ এবং অসমাপ্ত, আবার কোনো-কোনোটা উজ্জ্বল। সাহিত্যে যেখানেই জীবনের প্রভাব সমস্ত বিশেষ কালের প্রচলিত কৃত্রিমতা অতিক্রম করে সজীব হয়ে ওঠে সেইখানেই সাহিত্যের অমরাবতী । কিন্তু জীবন যেমন মূর্তিশিল্পী তেমনি জীবন রসিকও বটে। সে বিশেষ করে রসেরও কারবার করে। সেই রসের পাত্ৰ যদি জীবনের স্বাক্ষর না পায়, যদি সে বিশেষ কালের বিশেষত্বমাত্র প্রকাশ করে বা কেবলমাত্র রচনা-কৌশলের পরিচয় দিতে থাকে তা হলে সাহিত্যে সেই রসের সঞ্চয় বিকৃত হয় বা শুষ্ক হয়ে মারা যায়। যে রসের পরিবেশনে মহারসিক জীবনের অকৃত্রিম আস্বাদনের দান থাকে সে রসের ভোজে নিমন্ত্রণ উপেক্ষিত হবার আশঙ্কা থাকে না । 'চরণনখরে পড়ি দশ চাদ কঁদে এই লাইনের মধ্যে বাকচাতুরী আছে, কিন্তু জীবনের স্বাদ নেই। অপর পক্ষে তোমার ওই মাথার চুড়ায় যে রঙ আছে উজ্জ্বলি সে রঙ দিয়ে রাঙাও আমার বুকের কঁাচলিএর মধ্যে জীবনের স্পর্শ পাই, একে অসংশয়ে গ্ৰহণ করা যেতে পারে। শান্তিনিকেতন । দুপুর । ২৫ এপ্রিল ১৯৪১ छाछे ७8५ সাহিত্যে চিত্রবিভাগ আমরা পূর্বেই বলেছি যে, সাহিত্যে চিত্রবিভাগ যদি জীবনশিল্পীর স্বাক্ষরিত হয় তবে তার রূপের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সংশয় থাকে না। জীবনের আপনি কল্পনার ছাপ নিয়ে আঁকা হয়েছে যে-সব ছবি তারই রেখায় রেখায় রঙে রঙে সকল দেশে সকল কালে মানুষের সাহিত্য পাতায় পাতায় ছেয়ে গেছে। তার কোনোটা-বা ফিকে হয়ে এসেছে ; ভেসে বেড়াচ্ছে ছিন্নপত্র তার আপনি কালের স্রোতের সীমানায়, তার বাইরে তাদের দেখতেই পাওয়া যায় না। আর কতকগুলি আছে চিরকালের মতন সকল মানুষের চোখের কাছে সমুজ্জ্বল হয়ে । আমরা একটি ছবির সঙ্গে পরিচিত আছি, সে রামচন্দ্রের। তিনি । প্ৰজারঞ্জনের জন্যে নিরপরাধা সীতাকে বনবাস দিয়েছিলেন। এত বড়ো মিথ্যা ছবি খুব অল্পই আছে সাহিত্যের চিত্রশালায়। কিন্তু যে লক্ষ্মণ আপনি হৃদয়ের বেদনার সঙ্গে অমিল হলে অধৈর্যের সঙ্গে উড়িয়ে দিতেন শাস্ত্রের উপদেশ এবং দাদার পন্থার অনুসরণ, অথচ চিরাভ্যস্ত সংস্কারের বন্ধনকে কাটাতে না পেরে নিষ্ঠুর আঘাত করতে বাধ্য হয়েছেন। আপন শুভবুদ্ধিকে, যার মতন কঠিন আঘাত জগতে আর নেই- সেই সর্বত্যাগী লক্ষ্মণের ছবি তার দাদার ছবিকে ছাপিয়ে চিরকাল সাহিতো। উজ্বল হয়ে থাকবে । ও দিকে দেখে ভীষ্মকে, তার গুণগানের অন্ত নেই, অথচ কীেরবসভার চিত্রশালায় তার ছবির ছাপ পড়ল না। তিনি বসে আছেন একজন নিষ্কর্ম ধর্ম-উপদেশ-প্রতীক মাত্র হয়ে। ও দিকে দেখো কৰ্ণক, বীরের মতন উদার, অথচ অতিসাধারণ মানুষের মতন বার বার ক্ষুদ্রাশয়তায় আত্মবিস্মৃত । এ দিকে দেখো বিদুরকে, সে নিখুঁত ধাৰ্মিক ; এত নিখুঁত যে, সে কেবল কথাই কয় কিন্তু কেউ তার কথা মনতেই চায় না। অপর পক্ষে স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র ধর্মবুদ্ধির বেদনায় প্রতি