পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Nebr রবীন্দ্র-রচনাবলী রসের সৃষ্টিতে সর্বত্রই অত্যুক্তির স্থান আছে, কিন্তু সে অত্যক্তিও জীবনের পরিমাণ রক্ষা করে তবে নিস্কৃতি পায়। সেই অত্যুক্তি যখন বলে “পাষাণ মিলায়ে যায়” গায়ের বাতাসে তখন মন বলে, এই মিথ্যে কথার চেয়ে সত্য কথা আর হতে পারে না। রসের অত্যুক্তিতে যখন ধ্বনিত হয় “লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখানু তবু হিয়ে জুড়ন না গেল। তখন মন বলে, যে হৃদয়ের মধ্যে প্রিয়তমকে অনুভব করি। সেই হৃদয়ে যুগযুগান্তরের কোনো সীমচিহ্ন পাওয়া যায় না। এই অনুভূতিকে অসম্ভব অত্যুক্তি ছাড়া আর কী দিয়ে ব্যক্ত করা যেতে পারে। রসসৃষ্টির সঙ্গে রূপসৃষ্টির এই প্ৰভেদ ; রূপ আপন সীমা। রক্ষা করেই সত্যের আসন পায়, আর রস সেই আসন পায় বাস্তবকে অনায়াসে উপেক্ষা করে । তাই দেখি, সাহিত্যের চিত্রশালায় যেখানে জীবনশিল্পীর নৈপুণ্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সেখানে মৃত্যুর প্রবেশদ্বার রুদ্ধ । সেখানে লোকখ্যাতির অনিশ্চয়তা চিরকালের জন্যে নির্বাসিত । তাই বলছিলেম, সাহিত্যে যেখানে সত্যকার রূপ জেগে উঠেছে সেখানে ভয় নেই। চেয়ে দেখলে দেখা যায়, কী প্ৰকাণ্ড সব মূর্তি, কেউ-বানীচ শকুনির মতো, মন্থরার মতো, কেউ-বা মহৎ ভীমের মতো, দ্ৰৌপদীর মতোআশ্চর্য মানুষের অমর কীর্তি জীবনের চির-স্বাক্ষরিত। সাহিত্যের এই অমরাবতীতে র্যারা সৃষ্টিকর্তার আসন নিয়েছেন তাদের কারও-বা নাম জানা আছে, কারও-বা নেই, কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে তাদের স্পর্শ রয়ে গেছে। তাদের দিকে যখন তাকাই তখনই সংশয় জাগে নিজের অধিকারের প্রতি । আজ জন্মদিনে এই কথাই ভাববার- রসের ভোজে কিংবা রূপের চিত্রশালায় কোনখানে আমার নাম কোন অক্ষরে লেখা পড়েছে। লোকখ্যাতির সমস্ত কোলাহল পেরিয়ে এই কথাটি যদি দৈববাণীর যোগে কানে এসে পৌঁছতে পারত তা হলেই আমার জন্মদিনের আয়ু নিশ্চিত নিগীত হত। আজ তা বহুতর অনুমানের দ্বারা জড়িত বিজড়িত । শান্তিনিকেতন । বৈশাখ ১৩৪৮ छाछे S७8v সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা আমরা যে ইতিহাসের দ্বারাই একান্ত চালিত, এ কথা বার বার শুনেছি, এবং বার বার ভিতরে ভিতরে খুব জোরের সঙ্গে মাথা নেড়েছি। এ তর্কের মীমাংসা আমার নিজের অন্তরেই আছে, যেখানে আমি আর-কিছু নই, কেবলমাত্র কবি । সেখানে আমি সৃষ্টিকর্তা, সেখানে আমি একক, আমি মুক্ত ; বাহিরের বহুতর ঘটনাপুঞ্জের দ্বারা জালাবদ্ধ নই। ঐতিহাসিক পণ্ডিত আমার সেই কাব্যসৃষ্টির কেন্দ্র থেকে আমাকে টেনে এনে ফেলে যখন, আমার সেটা অসহ্য হয় । একবার যাওয়া যাক কবিজীবনের গোড়াকার সূচনায় । - শীতের রাত্রি- ভোরবেলা, পাণ্ডুবৰ্ণ আলোক অন্ধকার ভেদ করে দেখা দিতে শুরু করেছে। আমাদের ব্যবহার গরিবের মতো ছিল। শীতবস্ত্রের বাহুল্য একেবারেই ছিল না। গায়ে একখানামাত্র জামা দিয়ে গরম লেপের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতুম। কিন্তু এমন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। অন্যান্য সকলের মতো আমি আরামে অন্তত বেলা ছটা পর্যন্ত গুটিসুটি মেরে থাকতে পারতুম | কিন্তু আমার উপায় ছিল না। আমাদের বাড়ির ভিতরের বাগান সেও আমারই মতো দরিদ্র। তার প্রধান সম্পদ ছিল পূবদিকের পাচিল ঘেঁষে এক সার নারকেল গাছ। সেই নারকেল গাছের কম্পমান পাতায় আলো পড়বে, শিশিরবিন্দু ঝলমল করে উঠবে, পাছে আমার এই দৈনিক । দেখার ব্যাঘাত হয় এইজন্য আমার ছিল এমন তাড়া। আমি মনে ভাবতুম, সকালবেলাকার এই আনন্দের অভ্যর্থনা সকল বালকেরই মনে আগ্রহ জাগাত। এই যদি সত্য হত তা হলে সর্বজনীন